বারিদ বরন গুপ্ত'র নিবন্ধ




আমার জীবনের অর্ধেক সময়,বলতে গেলে আমার যৌবনের সেই সোনাঝরা দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছে যে শহরটি ঘিরে তা অবশ্যই হাওড়া শহর। আজকে ফেলে আসা শহরের সেই সোনাঝরা দিনগুলো তুলে ধরতে আমাকে স্মৃতির অতলে ডুব দিতেই হচ্ছে, বারবার তুলে আনতে হচ্ছে সেই মধুর সম্পর্ক গুলো, সেই ফ্রেমে বাঁধানো মুহূর্তগুলো যেগুলি মনের মনিকোঠায় আজও চির অমলিন।

সময়টা খুব সম্ভবত ১৯৮৫  প্রথমদিকের,
সদ্য কালনা কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষা ,জীবন ও জীবিকার খোঁজে পাড়ি দিই হাওড়া শহরে এবং বাসা বাঁধি উত্তর হাওড়ার গোলাম আব্বাস লেনে, সেখানে কাটে আমার জীবনের, যৌবনের সেরা সময়টা। আজ স্মৃতির আয়নায় ফুটে উঠছে সেই সব মুখগুলো যাদের সাথে সকাল-সন্ধ্যায় কতো সোনালী মুহূর্ত  কেটে গেছে, আজকে তারা অনেকেই বেঁচে আছে ,অনেকেই হয়তো পৃথিবী ছেড়ে চির বিদায় নিয়েছে। আজকে মাসিমা, ছবি দিদি, বাবলু এদের কথা বার বার মনে হচ্ছে ,এদের ভালোবাসার অকৃত্রিমতা মনে হতো না বাড়ির বাইরে আছি। এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে মন্টুদার কথা, কত সুখ দুঃখের সাথী ,কত সোনালী সন্ধ্যা কাটিয়েছি ঘন্টার পর ঘন্টা গল্পও করে, হঠাৎ একদিন সংসারের টানাপড়েনে সিলিং ফ্যানের ফাঁসে চির বিদায় জানালো পৃথিবীকে।
                       
আজকে স্মৃতির সরণি বেয়ে একে একে উঠে আসছে জগন্নাথ পার্ক,চামেলিয়া পার্ক ,জটাধারী পার্ক, বেলেলিয়াস পার্কে বন্ধুদের সাথে কাটানো সেই সুন্দর মুহূর্ত গুলো,আর মনে পড়ে যাচ্ছে গৌতম, রাকেশ অভিজিৎদের সাথে ক্রিকেট খেলার মুহূর্ত গুলো যেন মনের কোণে আজও অমলিন। আজ মনে আরও ভিড় করছে খেলার বন্ধুদের সাথে সালকিয়া গঙ্গার ঘাটে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা, নানা কথা, কখনো কখনো লঞ্চে গঙ্গার বুকে দাপাদাপি, আজো স্মৃতির আয়নায় সেই সব সুখের মুহূর্তগুলো কেনো জানিনা মনকে এলোমেলো করে দিচ্ছে, আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে স্মৃতির অ্যালবামে।

আজ ফেলে আসা শহর ও হারানো প্রেম খুঁজতে আমাকে ছুটে যেতে হচ্ছে হাওড়া কদমতলার শ্রীকৃষ্ণ ভগত লেনে। আমার জীবনের অ্যালবামের বেশ কয়েকটা বছর অতিবাহিত করতে হয়েছে বসন্ত, অশোক আর সনাতনদের সঙ্গে। তারা আদপে কেউ হাওড়ার স্থায়ী বাসিন্দা ছিল না , জীবন ও জীবিকার তাগিদে এখানে এসেছিল, কিন্তু সুখে-দুখে সবাই যেন একাকার হয়ে ছিলাম। আজ বারে বারে বসন্ত দার কথা মনে পড়ছে, উত্তর প্রদেশ থেকে এসেছিল, বয়সে আমার থেকে বেশ কয়েক বছরের বড় ছিল, তবুও আমাকে বন্ধুর মতো, ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছিল। জানি না তারা আজ কে কেমন আছে, ঈশ্বরের কাছে কামনা সবাই যেন সুখে থাকে।

                  উত্তর হাওড়ার রোজ মেরি লেন  কেন জানিনা আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগে! আজ জীবন সায়াহ্নে এসে বারবার ১০ নম্বর রোজ মেরি লেনের কথাই মনে আসছে। এখানে আমার ভালোবাসার বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। বেবি, ববি, রঞ্জিত গৌতম বিশু এদের কথাই আজ বারংবার  উঠে আসছে, কি সুন্দর ছিল সেই দিনগুলি! একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়ার সেই মুহূর্তগুলি যেন‌‌‌ আজ সব স্মৃতি, আমার স্মৃতির দর্পণে বারে বারে প্রতিফলিত হচ্ছে।
   
আজ স্মৃতির আয়নায় বারবার ভিড় করছে উত্তর হাওড়ার পিলখানা থার্ড বাইলেনের থান্ডার পরিবারকে, যাদের ভালোবাসা মানবিকতা আমার পক্ষে ভোলা কোনদিন সম্ভব নয়। সবশেষে আমাকে আরেকজনের কথা বলতেই হচ্ছে, তিনি আর কেউ নন উত্তর হাওড়া সেন্ট্রাল কোচিং সেন্টারের পরিচালক মানস বোস। শুধু একজন সহ শিক্ষক হিসেবে নয়, ভাইয়ের মত আমাকে দেখেছেন, সুখে দুঃখে সবসময় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, একজন শিক্ষকের মধ্যে এত গুণের বিকাশ আমি আজ পর্যন্ত দেখতে পাইনি, আজ মানস দা আমাদের মধ্যে নেই, তবুও চিরকাল তিনি আমার পরামর্শদাতা হিসেবে থেকে যাবেন।

আজ জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে আমার ফেলে আসা শহরের সেইসব সোনালী দিনের স্মৃতি আজও অমলিন হয়ে আছে আমার স্মৃতির দর্পণে। স্মৃতি তুমি সুখের না দুঃখের জানিনা, শুধু একটাই জানি আমার ফেলে আসা শহর ,ফেলে আসা যৌবন ,হারিয়ে যাওয়া প্রেম চির অমলিন হয়ে থাক আমার স্মৃতির ফ্রেমে।

সাহিত্যিক বারিদ বরন গুপ্ত 
সাহাপুর, আসানপুর, পূর্ব বর্ধমান
























 



0 Comments