
অপরিণত প্রেমের গল্প
আমার ছোট শালি চন্দনা এসে বলল- জামাইবাবু পঁচিশে ডিসেম্বর কিন্তু ঘরে বসে থাকব না। কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে।
কোথায় যাবে বলো?
নন্দিকেশ্বরের মন্দির।
মানে সাঁইথিয়া। আমার মুখটা বোধহয় অজানা আকাঙ্ক্ষায় উজ্জ্বলতায় ভরে উঠল।
সেই সাঁইথিয়া। মানে গার্গী। আমি মনে মনে পুলকিত হয়ে গেলাম। আমার সেই মুখ কেউ লক্ষ্য করল কিনা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
হ্যাঁ। অনেকদিন ধরে পুজো দেব ভাবছি কিন্তু কিছুতেই আর হয়ে উঠছে না।
নিজেকে শান্ত করে বললাম, বেশ চলো।
আমার ছোট শালি থাকে কোন্ননগর। চব্বিশ তারিখ বিকেলে চলে এল। এটা ওঁর প্রায়
প্রতি বছরের একটা ছোট্ট ট্যুর। আমি এবং আমার ছোট ভাইরাভাই দুজনেই স্কুলে শিক্ষকতা করি। তাই এই সময়টা দুজনেরই ছুটি থাকে। সেদিন রাত্রে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে পরদিন রওনা হলাম সাঁইথিয়া।
ট্রেনে যেতে যেতে বলছিলাম, জানো, একসময় আমরা এখানেই ছিলাম। বাবার চাকরি সূত্রে। বাবা টেলিফোন অপারেটার ছিলেন। এখানে যখন আসি আমার তখন সাড়ে তিন বছর বয়স। বাবা কলকাতা থেকে এখানে বদলি হয়ে এলেন। আমার লেখাপড়া এখান থেকেই শুরু। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি। তার পর বাবা আবার বদলি হলেন। চলে গেলাম বর্ধমান।
দেখতে দেখতে চলে এলাম সাঁইথিয়া। এখনও সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে। তবু অনেককিছু বদলেও গিয়েছে। শীতের রোদ গায়ে মাখতে মাখতে চলে এলাম নন্দিকেশ্বর এর মন্দিরে। মন্দিরের সেই ভাঙাচোরা পথ আর নেই। পিচের রাস্তা। সামনে ছোট ছোট কিছু দোকানপাট। তারা কেউ কেউ পুজোর ডালি বিক্রি করছে। মিষ্টির দোকান।
আর ঠিক উলটো দিক দিয়ে ফ্লাইওভারটা চলে গিয়েছে। ওদেরকে বললাম, জানো, এই ফ্লাইওভারটা পার হয়ে বেশ কিছুটা গেলে পড়বে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। সেখানে আমি বছরে একবার করে যেতাম। কোনদিন জানো? বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। বেশ বড় করে পুজো হত।
আমরা পুজোর ডালি নিয়ে পুজো দিলাম। ভোগের কুপন কাটলাম। সবাই এতক্ষণ উপবাস ছিল। তাই কিছু জলখাবার খাইয়ে দিয়ে বললাম, ভোগ হতে এখনও অনেক দেরি। তোমরা বরং একটু এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াও। সামনের রাস্তা ধরে সোজা গেলে ময়ুরাক্ষী নদী দেখতে পাবে। যাও ঘুরে এসো।
তুমি কোথায় যাবে? জানতে চাইল বন্দনা।
না জামাইবাবু, আমাদের রেখে আপনি কোথাও যাবেন না।
শোনো, এখানে একসময় থেকেছি। আমার এক বন্ধু আছে এখানে। একবার গিয়ে খোঁজ করে আসি। যদি পেয়ে যাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব।
আপনার ওই একটাই বন্ধুর কথা মনে আছে?
আছে আরও কয়েকজনের। কিন্তু ওদের বাড়ি ঠিক চিনি না।
ছোট ভাইরাভাই বলল, যেতে চাইছে যখন যাক না আমরা বরং নদীটা দেখে আসি।
শুনেছি খুব ভয়ঙ্কর নদী ছিল এক সময়। এই ময়ুরাক্ষী নদী নিয়ে তারাশংকরের অনেক গল্প আছে। তুমি যাও নিলাদ্রী। আমরা এদিকটা একটু ঘোরাঘুরি করি।
ওদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হল। রাস্তাটুকু পার করে চেপে থাকা শ্বাস ছেড়ে মনে মনে উচ্চারণ করলাম, গার্গী। সামনেই একটা ফাঁকা রিকশা পেয়ে উঠে পড়লাম। হাসপাতালের পিছন দিকের পাড়াতে যাব। একসময় সেখানেই
থাকত গার্গীরা।
ওদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিল। বাবার ব্রীজ খেলার পার্টনার ছিলেন অরিন্দমকাকু। সেই উপলক্ষে প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতেন নতুবা বাবা যেতেন ওদের বাড়ি। সেটা রবিবার থাকত বলে আমাদেরও কিছুটা সুবিধে হত। আমরাও খেলতাম। কখনও রবিবারে বাবার ডিউটি থাকলে আমি একাই চলে যেতেম ওদের বাড়ি।
উদ্দেশ্য গার্গীর সঙ্গে খেলা। ছোট্ট গোলগাল চেহারা। টকটকে ফর্সা ছিল ওঁর গায়ের রঙ। একঢাল বাবরি টাইপ চুল। মাথার মাঝখান দিয়ে লাল রঙের একটা ফিতে বাঁধা থাকত। কলকল করে কথা বলত। কেন কে জানে আমার ওকে খুব ভাল লাগত। মনে
হত ও যেন সবসময় আমার কাছে থাকে। আমি ওকে দেখব। খেলব। কথা বলব।
রিকশায় যেতে যেতে আজও একটা মেলার কথা মনে পড়ে। ময়ুরাক্ষী নদীর পাড়ে একটা বড় মাঠে মেলা হত। এই শীতের সময়। আমরা গিয়েছি। ওঁরাও গিয়েছে। ওঁর সঙ্গে দেখা হতেই মন ভরে গেল। আমরা হাত ধরাধরি করে মেলার মাঠে ঘুরছি। হঠাৎ দেখলাম একটা দোকানে খুব সুন্দর একটা পুতুল। বেশ বড় আকারের। দেখতে ঠিক যেন গার্গীর মতো। লাল একটা জামা পড়া। পুতুলটা দেখেই আমার খুব পছন্দ হল। আমি বাবাকে গিয়ে বললাম, বাবা আমাকে একটা পুতুল কিনে দেবে?
আমার মুখ থেকে ‘পুতুল’ শব্দটা শুনে সবাই আমার দিকে তাকাল। আমার বাবা, মা, অরিন্দমকাকু, কাকিমা। সবাই। তার পর বাবা বললেন, পুতুল দিয়ে তুমি কী করবে?
আমি একজনকে দেব।
কাকে?
গার্গীকে।
পুতুলটা পেয়ে গার্গী খুব খুশি হয়েছিল। আমি যখনই ওদের বাড়ি গিয়েছি দেখেছি গার্গী আমার দেওয়া পুতুলটা নিয়ে খেলছে। আমি একদিন বললাম, গার্গী, মনে করবে এই পুতুলটাই আমি।
গার্গী তখন কী বুঝেছিল কে জানে। সে ঘাড় নেড়ে বলেছিল- ঠিক আছে।
সেদিন আমার যে কী আনন্দ হয়েছিল-। শুধু মনে মনে ভাবতাম আমি সবসময় গার্গীর কোলে বসে আছি। জানি না একে প্রেম বলে কিনা! তবে আমি ওকে পছন্দ করতাম।
এভাবে মেলামেশা, কথাবার্তা, খেলাধুলোর মধ্যে দিয়ে কেটে গেল আরও একটা বছর।আর সেই বছরটাই আমার জীবনের এক চরম ক্ষতি। বাবাকে বদলি হয়ে চলে আসতে হলবর্ধমান। আজও মনে আছে ওঁরা আমাদের ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল। অরিন্দমকাকু
বাবাকে বলেছিলেন ছুটি ছাটায় চলে আসবেন। গার্গী তখন কী বুঝেছিল কে জানে।
সে তার মাকে বলল, মা, নীলুদারা আর এখানে থাকবে না? তার মা মাথা নেড়েছিল।
ট্রেন ছাড়ার সময় গার্গী হাত নাড়িয়েছিল। দেখেছিলাম ওঁর করুণ মুখটাকে। হয়তো মনে মনে কষ্ট পেয়েছিল এই ভেবে তাঁর খেলার সাথী চলে গেল।
নাহ, আর কোনদিনও সেখানে যাওয়া হয় নি। আজ কত বছর বাদে শালির অনুরোধে এখানে এলাম। জানি না গার্গীরা এখানে আছে কিনা। তাই এতবছর বাদে জীবনের প্রথম প্রেম নাকি ভালবাসা না নেহাতই শিশুসুলভ বন্ধুত্বকে দেখতে একবার মন চাইল।
এবার প্রধান রাস্তা ছেড়ে আমরা গলি পথে ঢুকে গেলাম। আমি পথের দিকে চোখ রেখে বসে আছি। এই পথ আমার চেনা। তবু আজ যেন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। বড় বড় বাড়ি। সামনে গ্যারেজ ঘর। রাস্তাটাও বেশ চওড়া হয়েছে।দূরে একটা হলুদ রঙের
বাড়ি দেখতে পেয়েই আমার মন আনন্দে নেচে উঠল। পেয়েছি। পেয়েছি। এই তো সেই বাড়ি। দাঁড়াও ভাই। এই বাড়িটাই। আমি রিকশা থেকে নেমে বললাম- তুমি একটু বস।
কলিং বেলে হাত দিতেই ডিং ডং করে বেজে উঠল।
ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল- কে।
একটু আসবেন।
দরজা খুলে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা বললেন, কাকে চাই?
আচ্ছা, এটা কি অরিন্দমবাবুর বাড়ি?
আপনি কোথা থেকে আসছেন?
বর্ধমান থেকে।
আপনি অরিন্দমবাবুর কে হন?
পরিচিত। একসময় আমরা এখানেই থাকতাম। উনি আমার বাবার বন্ধু। তার পর ভদ্রমহিলাকে একটু ভাল করে লক্ষ্য করলাম। উনিই কী কাকিমা। বলেই ফেললাম।আপনিই কি অরিন্দমকাকুর স্ত্রী?
উনি হেসে বললেন না, না। আপনি যাকে খুঁজতে এসেছেন তিনি আজ থেকে বহু বছর আগে এখান থেকে চলে গিয়েছেন। উনি আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। তখন আমরা উপরের ঘরে থাকতাম। আসুন। ঘরে আসুন।
না, ঠিক আছে। আমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই দেখলাম বন্দনা ফোন করেছে। ওকে
কোনও কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম, আমি এখুনি ফিরছি।
ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছে। আমি মেয়েকে কোলে নিয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করছি আর গার্গীর কথা ভাবছি। ইস খুব ভুল হয়ে গিয়েছে। আরও আগে যদি খোঁজ খবর করতাম তাহলে খুব ভাল হত। কোথায় গিয়েছে ভদ্রমহিলা জানেন না। সেই ঠিকানাটা পেলে
একবার অন্তত দেখা সাক্ষাৎ করতাম।
বিকেলের ট্রেন। একটু ভিড় থাকলেও এক সিটের একটা জায়গা পেলাম জানালার ধারে।
সেখানে বসে মোবাইল খুলে ফেসবুকে চলে গেলাম। সার্চ করলাম গার্গী নাম দিয়ে।অনেক গার্গী বের হয়ে এল। ওদের উপাধি জানতাম না। একটা একটা করে দেখতে লাগলাম। সেই ছোট্টবেলার গার্গীর মুখ যে এখন অনেক বদলে যাবে সেটা বুঝেও খুঁজতে লাগলাম হারিয়ে যাওয়া একটা ছোট্ট মুখকে। যে মুখ আজও আমার স্মৃতির মনিকোঠায় বসে আছে।
কোথায় যাবে বলো?
নন্দিকেশ্বরের মন্দির।
মানে সাঁইথিয়া। আমার মুখটা বোধহয় অজানা আকাঙ্ক্ষায় উজ্জ্বলতায় ভরে উঠল।
সেই সাঁইথিয়া। মানে গার্গী। আমি মনে মনে পুলকিত হয়ে গেলাম। আমার সেই মুখ কেউ লক্ষ্য করল কিনা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
হ্যাঁ। অনেকদিন ধরে পুজো দেব ভাবছি কিন্তু কিছুতেই আর হয়ে উঠছে না।
নিজেকে শান্ত করে বললাম, বেশ চলো।
আমার ছোট শালি থাকে কোন্ননগর। চব্বিশ তারিখ বিকেলে চলে এল। এটা ওঁর প্রায়
প্রতি বছরের একটা ছোট্ট ট্যুর। আমি এবং আমার ছোট ভাইরাভাই দুজনেই স্কুলে শিক্ষকতা করি। তাই এই সময়টা দুজনেরই ছুটি থাকে। সেদিন রাত্রে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে পরদিন রওনা হলাম সাঁইথিয়া।
ট্রেনে যেতে যেতে বলছিলাম, জানো, একসময় আমরা এখানেই ছিলাম। বাবার চাকরি সূত্রে। বাবা টেলিফোন অপারেটার ছিলেন। এখানে যখন আসি আমার তখন সাড়ে তিন বছর বয়স। বাবা কলকাতা থেকে এখানে বদলি হয়ে এলেন। আমার লেখাপড়া এখান থেকেই শুরু। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি। তার পর বাবা আবার বদলি হলেন। চলে গেলাম বর্ধমান।
দেখতে দেখতে চলে এলাম সাঁইথিয়া। এখনও সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে। তবু অনেককিছু বদলেও গিয়েছে। শীতের রোদ গায়ে মাখতে মাখতে চলে এলাম নন্দিকেশ্বর এর মন্দিরে। মন্দিরের সেই ভাঙাচোরা পথ আর নেই। পিচের রাস্তা। সামনে ছোট ছোট কিছু দোকানপাট। তারা কেউ কেউ পুজোর ডালি বিক্রি করছে। মিষ্টির দোকান।
আর ঠিক উলটো দিক দিয়ে ফ্লাইওভারটা চলে গিয়েছে। ওদেরকে বললাম, জানো, এই ফ্লাইওভারটা পার হয়ে বেশ কিছুটা গেলে পড়বে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। সেখানে আমি বছরে একবার করে যেতাম। কোনদিন জানো? বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। বেশ বড় করে পুজো হত।
আমরা পুজোর ডালি নিয়ে পুজো দিলাম। ভোগের কুপন কাটলাম। সবাই এতক্ষণ উপবাস ছিল। তাই কিছু জলখাবার খাইয়ে দিয়ে বললাম, ভোগ হতে এখনও অনেক দেরি। তোমরা বরং একটু এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াও। সামনের রাস্তা ধরে সোজা গেলে ময়ুরাক্ষী নদী দেখতে পাবে। যাও ঘুরে এসো।
তুমি কোথায় যাবে? জানতে চাইল বন্দনা।
না জামাইবাবু, আমাদের রেখে আপনি কোথাও যাবেন না।
শোনো, এখানে একসময় থেকেছি। আমার এক বন্ধু আছে এখানে। একবার গিয়ে খোঁজ করে আসি। যদি পেয়ে যাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব।
আপনার ওই একটাই বন্ধুর কথা মনে আছে?
আছে আরও কয়েকজনের। কিন্তু ওদের বাড়ি ঠিক চিনি না।
ছোট ভাইরাভাই বলল, যেতে চাইছে যখন যাক না আমরা বরং নদীটা দেখে আসি।
শুনেছি খুব ভয়ঙ্কর নদী ছিল এক সময়। এই ময়ুরাক্ষী নদী নিয়ে তারাশংকরের অনেক গল্প আছে। তুমি যাও নিলাদ্রী। আমরা এদিকটা একটু ঘোরাঘুরি করি।
ওদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হল। রাস্তাটুকু পার করে চেপে থাকা শ্বাস ছেড়ে মনে মনে উচ্চারণ করলাম, গার্গী। সামনেই একটা ফাঁকা রিকশা পেয়ে উঠে পড়লাম। হাসপাতালের পিছন দিকের পাড়াতে যাব। একসময় সেখানেই
থাকত গার্গীরা।
ওদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিল। বাবার ব্রীজ খেলার পার্টনার ছিলেন অরিন্দমকাকু। সেই উপলক্ষে প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতেন নতুবা বাবা যেতেন ওদের বাড়ি। সেটা রবিবার থাকত বলে আমাদেরও কিছুটা সুবিধে হত। আমরাও খেলতাম। কখনও রবিবারে বাবার ডিউটি থাকলে আমি একাই চলে যেতেম ওদের বাড়ি।
উদ্দেশ্য গার্গীর সঙ্গে খেলা। ছোট্ট গোলগাল চেহারা। টকটকে ফর্সা ছিল ওঁর গায়ের রঙ। একঢাল বাবরি টাইপ চুল। মাথার মাঝখান দিয়ে লাল রঙের একটা ফিতে বাঁধা থাকত। কলকল করে কথা বলত। কেন কে জানে আমার ওকে খুব ভাল লাগত। মনে
হত ও যেন সবসময় আমার কাছে থাকে। আমি ওকে দেখব। খেলব। কথা বলব।
রিকশায় যেতে যেতে আজও একটা মেলার কথা মনে পড়ে। ময়ুরাক্ষী নদীর পাড়ে একটা বড় মাঠে মেলা হত। এই শীতের সময়। আমরা গিয়েছি। ওঁরাও গিয়েছে। ওঁর সঙ্গে দেখা হতেই মন ভরে গেল। আমরা হাত ধরাধরি করে মেলার মাঠে ঘুরছি। হঠাৎ দেখলাম একটা দোকানে খুব সুন্দর একটা পুতুল। বেশ বড় আকারের। দেখতে ঠিক যেন গার্গীর মতো। লাল একটা জামা পড়া। পুতুলটা দেখেই আমার খুব পছন্দ হল। আমি বাবাকে গিয়ে বললাম, বাবা আমাকে একটা পুতুল কিনে দেবে?
আমার মুখ থেকে ‘পুতুল’ শব্দটা শুনে সবাই আমার দিকে তাকাল। আমার বাবা, মা, অরিন্দমকাকু, কাকিমা। সবাই। তার পর বাবা বললেন, পুতুল দিয়ে তুমি কী করবে?
আমি একজনকে দেব।
কাকে?
গার্গীকে।
পুতুলটা পেয়ে গার্গী খুব খুশি হয়েছিল। আমি যখনই ওদের বাড়ি গিয়েছি দেখেছি গার্গী আমার দেওয়া পুতুলটা নিয়ে খেলছে। আমি একদিন বললাম, গার্গী, মনে করবে এই পুতুলটাই আমি।
গার্গী তখন কী বুঝেছিল কে জানে। সে ঘাড় নেড়ে বলেছিল- ঠিক আছে।
সেদিন আমার যে কী আনন্দ হয়েছিল-। শুধু মনে মনে ভাবতাম আমি সবসময় গার্গীর কোলে বসে আছি। জানি না একে প্রেম বলে কিনা! তবে আমি ওকে পছন্দ করতাম।
এভাবে মেলামেশা, কথাবার্তা, খেলাধুলোর মধ্যে দিয়ে কেটে গেল আরও একটা বছর।আর সেই বছরটাই আমার জীবনের এক চরম ক্ষতি। বাবাকে বদলি হয়ে চলে আসতে হলবর্ধমান। আজও মনে আছে ওঁরা আমাদের ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল। অরিন্দমকাকু
বাবাকে বলেছিলেন ছুটি ছাটায় চলে আসবেন। গার্গী তখন কী বুঝেছিল কে জানে।
সে তার মাকে বলল, মা, নীলুদারা আর এখানে থাকবে না? তার মা মাথা নেড়েছিল।
ট্রেন ছাড়ার সময় গার্গী হাত নাড়িয়েছিল। দেখেছিলাম ওঁর করুণ মুখটাকে। হয়তো মনে মনে কষ্ট পেয়েছিল এই ভেবে তাঁর খেলার সাথী চলে গেল।
নাহ, আর কোনদিনও সেখানে যাওয়া হয় নি। আজ কত বছর বাদে শালির অনুরোধে এখানে এলাম। জানি না গার্গীরা এখানে আছে কিনা। তাই এতবছর বাদে জীবনের প্রথম প্রেম নাকি ভালবাসা না নেহাতই শিশুসুলভ বন্ধুত্বকে দেখতে একবার মন চাইল।
এবার প্রধান রাস্তা ছেড়ে আমরা গলি পথে ঢুকে গেলাম। আমি পথের দিকে চোখ রেখে বসে আছি। এই পথ আমার চেনা। তবু আজ যেন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। বড় বড় বাড়ি। সামনে গ্যারেজ ঘর। রাস্তাটাও বেশ চওড়া হয়েছে।দূরে একটা হলুদ রঙের
বাড়ি দেখতে পেয়েই আমার মন আনন্দে নেচে উঠল। পেয়েছি। পেয়েছি। এই তো সেই বাড়ি। দাঁড়াও ভাই। এই বাড়িটাই। আমি রিকশা থেকে নেমে বললাম- তুমি একটু বস।
কলিং বেলে হাত দিতেই ডিং ডং করে বেজে উঠল।
ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল- কে।
একটু আসবেন।
দরজা খুলে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা বললেন, কাকে চাই?
আচ্ছা, এটা কি অরিন্দমবাবুর বাড়ি?
আপনি কোথা থেকে আসছেন?
বর্ধমান থেকে।
আপনি অরিন্দমবাবুর কে হন?
পরিচিত। একসময় আমরা এখানেই থাকতাম। উনি আমার বাবার বন্ধু। তার পর ভদ্রমহিলাকে একটু ভাল করে লক্ষ্য করলাম। উনিই কী কাকিমা। বলেই ফেললাম।আপনিই কি অরিন্দমকাকুর স্ত্রী?
উনি হেসে বললেন না, না। আপনি যাকে খুঁজতে এসেছেন তিনি আজ থেকে বহু বছর আগে এখান থেকে চলে গিয়েছেন। উনি আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। তখন আমরা উপরের ঘরে থাকতাম। আসুন। ঘরে আসুন।
না, ঠিক আছে। আমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই দেখলাম বন্দনা ফোন করেছে। ওকে
কোনও কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম, আমি এখুনি ফিরছি।
ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছে। আমি মেয়েকে কোলে নিয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করছি আর গার্গীর কথা ভাবছি। ইস খুব ভুল হয়ে গিয়েছে। আরও আগে যদি খোঁজ খবর করতাম তাহলে খুব ভাল হত। কোথায় গিয়েছে ভদ্রমহিলা জানেন না। সেই ঠিকানাটা পেলে
একবার অন্তত দেখা সাক্ষাৎ করতাম।
বিকেলের ট্রেন। একটু ভিড় থাকলেও এক সিটের একটা জায়গা পেলাম জানালার ধারে।
সেখানে বসে মোবাইল খুলে ফেসবুকে চলে গেলাম। সার্চ করলাম গার্গী নাম দিয়ে।অনেক গার্গী বের হয়ে এল। ওদের উপাধি জানতাম না। একটা একটা করে দেখতে লাগলাম। সেই ছোট্টবেলার গার্গীর মুখ যে এখন অনেক বদলে যাবে সেটা বুঝেও খুঁজতে লাগলাম হারিয়ে যাওয়া একটা ছোট্ট মুখকে। যে মুখ আজও আমার স্মৃতির মনিকোঠায় বসে আছে।
0 Comments