সময়ের মুখোমুখি
( ১)
হসপিটাল গুলোতে এখন খুব চাপ। কড়া কড়ির সাথে সতর্কীকরণ সিডিউল গুলোকে পুরো ঘেঁটে ঘ করে দিয়েছে । পিকু ওরফে চারুলতা গাড়িতে যেতে যেতে তাই ভাবছিল। বাইরের আবহাওয়া টা এখন বেশ গরম।কলকাতা থেকে ঠান্ডা চলে যেতে বেশি সময় না লাগলেও এই বছরটা ছিল ব্যতিক্রম,শীতকালটা বেশ কিছুদিন উপভোগ করার সুযোগ ছিল অনেক বছর পর।
পিকুর বয়স চব্বিশের মত। চুলটা ঘাড় পর্যন্ত ছোট করে ছাটা গায়ের রং মোটামুটি ফর্সা। মেদহীন পাঁচ ফুটের মতো দৈর্ঘ্য। মুখের ছাপটা হুবহু বনানী দেবী মানে ওর মায়ের সাথে মিলে যায়। অমনি পাতলা ঠোঁট চোখ দুটো নিকষ কালো মনিযুক্ত। জোড়া ভ্রু এবং কালো মনির পাশের চোখের কালো তিল সুস্পষ্ট বোঝা যায় ওর মায়ের মতই । বরাবর সিরিয়াস পিকু, পড়াশোনায় রীতিমতো সফল।মেডিকেলে চান্স পেতে তাই বেশি বেগ পেতে হয়নি। বছরখানেক ধরে কলকাতার নামী সরকারি বেসরকারি হসপিটালে নিজেকে প্র্যাকটিস করার জন্য তৈরি করে নিচ্ছে পিকু। আরেকটা গুণের জন্য অবশ্য পিকুর বদনাম আছে ,পিকু ঠোঁট কাটা। এই স্বভাবটা পেয়েছে বাবার কাছ থেকে। পিকুর বাবা ছিলেন নামজাদা উকিল। ছিলেন উল্লেখিত হল কারণ মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পরই পিকুর বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।তখন থেকে নিজের সাথে যুদ্ধ টা শুরু।তাই আর পাঁচটা মেয়ের তুলনায় পিকু আলাদা।সাহস টা ওর বরাবর বেশি।
ব্লু ডেনিম জিন্সের পকেটে ফোনটা বেজে উঠলো..."ইয়েস ডঃ চারুলতা স্পিকিং"
"ম্যাম আপনার আসতে দেরি আছে এখনো? ডক্টর সান্যাল ওয়েট করছেন আপনি এলে পেশেন্টকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হবে ।"
"ইয়া আই অ্যাম অন মাই ওয়ে,অলমোস্ট হসপিটালের কাছে এসে গেছি..ওটিতে নিয়ে যেতে বলো...কামিং সুন।"
জানালার কাঁচ দুটো তুলে দিয়ে এসিটা ফুলস্পিডে দিয়েছিল পিকু। চারিদিক থেকে সব গাড়িগুলো যখন সিগন্যালের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করে আগে যাবার জন্য তখন অসহ্য লাগে পিকুর। তারমধ্যে বাতাসে আজ বেশ আর্দ্রতা।নয়তো বাইরের খোলা মেলা হাওয়া খেতে পছন্দ করে পিকু। হসপিটালের কাছে আসতে বাক ঘুরতেই পাশ থেকে একটা গাড়ী এসে আচমকা ঘষা লাগাল পিকুর গাড়িতে। একটা তীব্র ঝাকুনিতে পিকু গাড়িটা পার্ক করল রাস্তার একপাশে।.." ইউ স্কাউন্ড্রেল,হোয়াট দ্য হেল আর ইউ ডুইং !!! "পিকু গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার করল এবং উল্টো দিকের গাড়ির চালক কে দেখার চেষ্টা করলো।
ততক্ষণে আশেপাশে কৌতুক লোকজন মৌমাছির মতো ভিড় করেছে দুটো গাড়ি ঘিরে। একে গাড়িতে গাড়িতে টক্কর তার উপর মহিলারগাড়ি। ওপ্রান্ত থেকে সাদা সেডান থেকে বেরোল বেশ লম্বা সুদীর্ঘ সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পরিহিত যুবক।
"সরি রিয়েলি আই এম সরি, একচুয়ালি ভুলটা আমার, নিউজ কভার করতে এসেছি বলে তাড়ায় ছিলাম।"
আশেপাশে ঘিরে ধরা যারা ভাবছিল ,আশা করছিল, সকালটায় বেশ চাটনি চাটা যাবে সে গুড়ে বালি ঢেলে দিল আলেখ্য...উল্টোদিকের পিকুর মুখোমুখি দাঁড়ানো যুবকটি। সকলেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নিভে যাওয়া উৎসাহ নিয়ে যে যার গন্তব্যের দিকে চলতে থাকে ভিড় টা পাতলা হয়ে যায়।
"গাড়িটা একবার তাকিয়ে দেখুন, খরচটা কে বেয়ার করবে? অভিয়াসলি আমি নই?"
"ওহ নো ,সো সরি ম্যাম কত খরচ হতে পারে আপনার?ডোন্ট ওরি ।আই উইল বেয়ার।"আলেখ্য উত্তর দেয়।
চারুলতা একটু আশ্বস্ত হয়।"ইটস ওকে। আপনারা সবার খবর নিতে গিয়ে এত তাড়াহুড়ো করেন আলটিমেটলি রুলস গুলো ভুলে যান।"
পিকু আবার উঠে বসে গাড়ীতে ও সিটবেল্ট টা বেঁধে নেয়। হসপিটালে পৌঁছে দেখে পরিস্থিতি আরও জটিল। গতকাল রাতে শ্বাস কষ্ট নিয়ে অ্যাডমিট হয়েছিল এক পেশেন্ট ভোররাতে মারা গেছে। হসপিটাল এনকোয়ারি থেকে জানা যায় হার্টের অসুখে ভুগছিলেন পেশেন্ট বহুদিন যাবৎ। কিন্তু অকস্মাৎ মৃত্যু তে পেশেন্ট পার্টি গেটের সামনে শোরগোল করতে শুরু করেছে।...."ম্যাম ,ম্যাম ... কাইন্ডলি ওদিকে যাবেন না। পেশেন্টের বাড়ির লোকেরা সব জড়ো হয়েছে ঝামেলা করছে, এখনই নিউজ চ্যানেলের লোকেরা ঢুকে পড়বে।"
"ও রিয়েলি? তাহলে তো একবার যেতেই হচ্ছে।"
"প্লীজ ম্যাম প্লীজ ডঃ সান্যাল বারবার ওয়ার্ন করেছেন যেন কেউ না যান।"
পিকু মুখটা ভেঙচে ডিসগাস্টিং বলে পাস কাটায়। ওটিতে গিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের সাথে কথা বলতে বলতে ডক্টর সান্যাল কে জানিয়ে পিকু একবার বাইরে বেরিয়ে আসে। চারিদিকে তাকায় এবং চেনা কোন ডাক্তারকে দেখতে না পেয়ে বেরিয়ে আসে করিডরের কাছে। জনরোষে উত্তপ্ত পুরো চত্বর উপচে পড়ছে ভিড়ে। পিকু একবার চোখ বোলায় চারদিকে আসল ব্যাপারটা কি হয়েছে আঁচ করতে চায়। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ বুঝতে পারে না সে। আনমনা হয়ে পিকু চিন্তা করে এবং চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ এক জায়গায় গিয়ে দৃষ্টি আটকে যায়। আরে এই ছেলেটা এত সকালে তার গাড়িতে ধাক্কা মারলো, তবে খবরটা এখানেই কভার করতে এসেছে। এদের চারিদিকে কত যে স্পাই ঘুরছে, ডাক্তারদের কাছে খবর না গেলেও এদের কাছে ঠিক পৌঁছে যায়।
পিকু কাঁচের দরজা খুলে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতেই নিচে তাকিয়ে দেখল ডঃ রায় দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন কাঁচুমাচু মুখে, এমন সময় একটা বড় পাথর ধেয়ে এলো সামনে দাঁড়ানো ডক্টর রায় কে লক্ষ্য করে। লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পাথরটা লাগলো সকালের ওই যুবকের কপালে ।ঘটনাটা এতটা আচমকা ঘটল পুলিশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুবকটির লুটিয়ে পড়ল কপালে হাত দিয়ে। সাদা জামায় তাজা রক্তের স্রোতে ভাসছে, পিকু আর বিলম্ব করলোনা ,তরতর করে নেমে এলো নিচে।
(২)
ছোটবেলাটা ছিল রূপকথার মতো বাড়ির সামনে কালো দিঘী ভরা জল ,ময়না নদী ,ভরা সবুজ প্রান্তর। মাঝে ছিল তাদের বসতি।নদীর ধারে মাঝে মাঝে খুকু চলে যেত স্নান করার একটু আগে। বিশাল বয়স্ক বটগাছের কোলে বসে গল্প জমাত ও খাদু, ছবি ,নন্দা ওর বন্ধুরা একসাথে। বটের মাথা থেকে ঝুড়ি গুলো নেমে নেমে আবার কান্ড হয়ে মাটিতে গেঁথে গেছে। শিকড়ে শিকড়ে ছেয়ে গেছে মাটির কাছটা। লাল মাটির ওপর গাছের কোটরে ছিল নানা পাখির বাসা। খুকু শাড়িটা গাছকোমর করে বেঁধে ঝুরি ধরে ঝুলত। আঁচলায় ভরে ভরে ছোট ছোট মাছ ধরত। পুকুরে খালুই পাতন দিয়ে মাছ ধরত যেমন ওদের বাড়ির বাঁকা মাঝি। ওর কাছ থেকে শেখা, তখন বয়স বছর পনের হবে। বাবা আদর করে ডাকতেন খুকু। আর একটা নাম অবশ্য খুকুর আছে সেটা বাবাইদা ছাড়া আর কেউ জানে না। বনানী নামটা স্কুলের গণ্ডীতে ছিল সীমাবদ্ধ। বাবাই দাদা ডাকতো বকুলফুল বলে। এখন নামটা হারিয়ে গেলেও মনে মনে মাঝে মাঝে সেই নামে নিজেকে টেনে আনতে ইচ্ছা করে। খুকুর যত আবদার ছিল বাবাই দার কাছে। বাবাইদা তো কম ভালোবাসতো না। কিশোরী মনের প্রথম ভালোলাগা ও ভালোবাসার যে সুস্পষ্ট দাগ কাটতে পারে জীবনভর তা আজও পরতে পরতে টের পায় বনানী। তাই খুলনার বাড়িটা মনে পড়লে বাবাইদার মুখটা সবার আগে মনে পড়ে। তার মনে পড়ে নদীর পাড়ে দৌড়তে দৌড়তে বাবাই দার সাথে যখন আছাড় খেয়ে ছিল বট গাছের গুঁড়িতে ,কপালে ক্ষত হয়েছিল বেশ খানিকটা। বাবাইদা একদম কাছে টেনে নিয়েছিল সেদিন। কপালের গড়িয়ে যাওয়া রক্ত নিজের হাতে মুছে দিয়েছিল সন্ধ্যা নামার প্রাক্কালে। পূর্ণিমা ছিল কিনা আজও বনানী মনে করতে পারে না তবে বাবাইদার কথা গুলো এখনও কানে বাজে।"বকুলফুল চাঁদের মুখে যে দাগ হয়ে গেল!"
ফিসফিসিয়ে বলেছিল কানে ,কি ভীষণ লজ্জা পেয়েছিল বনানী।
তারও বছরখানেক পরে যখন বনানী পরীক্ষা দিচ্ছিল টুয়েলভ ক্লাসে তখন দাঙ্গা লেগে ছিল ভীষণ। চারিদিকে শুধু রক্তপাত, লড়াই, কাড়াকাড়ি ভাগাভাগি। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হানাহানি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল দিনদিন। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হলেও এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে সেই দেশ ছাড়তে হবে। নিজের মাটি ছাড়তে হবে আঁকড়ে পড়ে থাকার কোন উপায় নেই।
দেয়ালে পিঠ ঠেকা অব্দি মানুষ চূড়ান্ত চেষ্টা করে যায়, মাও সেই চেষ্টা করেছিল। অবশেষে যেদিন দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের ঘর বাড়ি, নিকানো উঠোন,সকালের পরিষ্কার করে ধোয়া তুলসী তলা বনানীর শুধু মনে হয়েছিল ওর চোখের সামনে ওর শৈশব জ্বলছে,ওর কৈশোর জ্বলছে ,ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এর পারাবারে। ছোট ভাইটাকে নিয়ে বাবা-মা'র হাত ধরে ডিঙিতে উঠে যখন বসেছিল বাবাইদা দৌড়তে দৌড়তে ভোরের আলোয় নদীর পাড়ে ছুটে এসেছিল। ডিঙ্গি তখন ছেড়ে দিয়েছে। বনানী কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। সাঁতরে সাঁতরে সুগভীর জলে নদীর পাড়ে গিয়ে বাবাইদার বুকে মাথা রাখতে ইচ্ছে করছিল খুব, শক্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে ইচ্ছে করছিল। বাবাই দাকে যতদূর দেখা গেছে ততদূর ঝাপসা চোখে বনানী দেখছিল আর মনে হচ্ছিল ডিঙ্গি বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া স্মৃতি, হৃদয় আর যেটুকু অগ্নিদগ্ধ অবশিষ্টাংশের মধ্যে থেকে বাঁচিয়ে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিল মা, সেগুলোর চেয়ে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিল, পুড়িয়ে খাক করে দিতে বাধ্য হয়েছিল জীবনের একটা অধ্যায়। নতুন করে শুরু করার জন্য পুরনো জীবনকে চোখের সামনে সলিল সমাধি দিতে হয়েছিল নিরুপায় ভাবে,অথর্বের মত। চোখ দিয়ে নোনা জল অবিরত বন্যার মতো বেয়েচলেছিল। মা বোধহয় বুঝেছিল, পোঁটলাপুটলি ডিঙিয়ে বুকে জড়িয়ে আর্তনাদ করেছিল তখন। বাবার অবশ্য শুষ্ক চোখে এক মুখ দাড়ি তে নৌকার একপ্রান্তে মাথা নিচু করে বসে ছিল ,একটা কথা বলেন নি।
(৩)
"আজ কেমন আছেন? স্টিচে ব্যাথা নেই তো?"পিকু শুধালো।
আলেখ্য পিকুর দিকে তাকিয়ে রসিকতা করে বলল,"তাহলে ভালোই কৃতকর্মের ফল ভোগ করলাম,কি তাই তো?"
"ওহ স্টপ ইট প্লিজ আর লজ্জা দেবেন না।"
" একদিকে অবশ্য ভালোই হল , বাড়িতে তো কপালে এমন সেবা জোটে না হসপিটালে অ্যাডমিট হয়ে ভালো হল।"
"কেন? মিসেস সেবা করেন না বলছেন?"
"সে ভাগ্য আর হলো কই? বিয়েটাই তো হল না ,ভাবছি আপনাদের এখান থেকেই কাউকে সাত পাকে বাঁধব ...তাহলে সারাজীবনের ট্রিটমেন্ট ফ্রি,কি বলেন?"
"দেখুন কাউকে পান কিনা।"পিকু উত্তর দিলো অস্বস্তি নিয়ে
"পেলেই কি আর সে রাজী হবে ?"আলেখ্য মনের কথা বলেই ফেললো।আসলে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট না হলেও যখন পিকু দৌড়তে দৌড়তে এসে সবার মধ্যে নিজের বিপদের তোয়াক্কা না করে আলেখ্য কে কোলে শুইয়ে কপালের রক্ত মুছিয়ে বীরাঙ্গনার মত সকলকে তীব্র তিরস্কার করে ভিড় টা পাতলা করে দিয়েছিল তখন কপালের ব্যথার সাথে সাথে বুকে একটা ভালো লাগার চিনচিনে ব্যাথাও অনুভব করছিল।
"মানে?"
"এই ধরুন আপনি কি রাজি হবেন?"আলেখ্য উঠে বসে।
চারুলতা অস্বস্তি বোধ করে।কি উদ্ধত রে বাবা! যতটা ভদ্র ভেবেছিল তাহলে ততটাও নয়। অবশ্য একটু কি বেশী প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছে ও। চারুলতা নিজেও বুঝতে পারে।কাল যখন স্টিচ টা করা হচ্ছিল তখন দুই হাতের মুঠোয় আলেখ্য র হাতটা শক্ত করে ধরেছিল পিকু।আর স্পষ্ট বুঝতে পারছিল আলেখ্যর ঘামে ভেজা হাত পিছলে গেলেও শক্ত মুঠোয় আটকে যাচ্ছে।
"আপনার আজকে ডিসচার্জ, ওষুধগুলো নিয়মিত খাবেন।"পাশ কাটাতে চাইলে চারুলতা। বাবাকে হারানোর পর চারুলতা চারপাশটা নিঃস্ব হয়ে গেছিল, ও বুঝতে পারছিল প্রয়োজনের তুলনায় বেশি দৃঢ়, রূঢ়হয়ে যাচ্ছে। নিজের সাথে মাকে আগলানো জন্য শক্ত খোলস টা আবৃত করে রাখতেই হত নিজের চারপাশে। তবু আলেখ্যর সাথে এইটুকু সময় কাটানোয় বুঝতে পারল ,তার মনে হলো শক্ত খোলস টা বারবার খসে পড়ছে।
"আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না তো?"
পিকু আলেখ্যর দিকে তাকায়। কপালের স্টিচ টা দেখে, বাঁ দিকের চোখটা ফুলে গেছে,চৌকো কপাল, চোখ দুটো বড় ,তাকালেই একটা অস্বস্তি হচ্ছে।"সাংবাদিকদের সাথে ঘর বাধার বহু ঝামেলা, খবর হাইলাইট হয়ে যাবে।"হেসে বলে পিকু।
"ক্ষতি কি? তাহলে তো জনপ্রিয় হয়ে যাবেন রাতারাতি।"
(৪)
প্রায় ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে আছে লেকের বাইরে আলেখ্য। গাড়িটা পার্ক করে একটা সিগারেট ধরালো। পিকু ফোনটা দুবার বেজে বেজে গিয়ে ছোট্ট মেসেজ এসেছে,"বিজি নাউ উইল কল ইউ লেটার"তার পরেও মিনিট পনেরো দাঁড়িয়ে আছে আলেখ্য, ঘামে সপসপ করছে জামাটা । কেমনথমথমে হয়ে আছে চারিদিকে গাছের পাতা নড়ছে না লেকের জল স্থির। মাস দুই
ধরে প্রতি সপ্তাহে দুজনের সময় বার করে লেকে দেখা করে দুজনে। কাছাকাছি আসতে বেশি সময় লাগে নি ওদের। বিশেষ করে যেদিন আলেখ্য বলেছিল,"আমরা কিন্তু বাঙাল!"
পিকু হেসে উঠেছিল,"আমরাও বাঙাল ,মা তো বাংলাদেশে ছেলেবেলা কাটিয়েছে।"
"তাই তাহলে তো একদিন আন্টির সাথে গল্পে যেতেই হবে!"
"আরে না না ,মাকে এখনো কিছু বলিনি বললেই এখন বিয়ের কথা বলবে।"
আলেখ্য অবশ্য প্রথম থেকে বাড়িতে সবটা জানিয়েছিল। মা-বাবার কাছে কিছু লুকোতে পারে না। বাবা কলেজ,পড়াশোনা নিয়ে প্রথম থেকেই ব্যস্ত, বাবার সাথে ছেলেবেলা থেকেই তাই দূরত্ব কিছুটা বেশি। শুধু আলেখ্যর সাথে নয় আলেখ্য লক্ষ্য করেছে দূরত্বটা কিছুটা মায়ের সাথেও। নিজের মধ্যে থাকতে ভালোবাসে বাবা, দিনরাত লেখালেখি করে, ছেলেবেলায় মাকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছে, কারণটা আজও বুঝতে পারে না।
ভাবনায় ডুবে দিতে দিতে আরেকটা ফোন করল পিকুকে আলেখ্য। আর তখনই দৌড়তে দৌড়তে পিকু গাড়িটা কোনরকম পার্ক করে হাঁপায় আলেখ্যর সামনে।
"জল খাওয়াও তো একটু, ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে প্রায় ছুটতে ছুটতে এলাম।"
আলেখ্য গাড়ির দরজা খুলে জলের বোতলটা বের করে ,সামনে ধরে,"পাক্কা দেড় ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি"
"আরে পুরো ঝুলে গেছিলাম।"
"তাই বলে দেড় ঘণ্টা!"
"তখনই বলেছিলাম ডাক্তারদের দিন-রাত নেই!"
"এখন সেটাই ভাবছি!"
"হোয়াট ডু ইউ মিন বাই সেটাই ভাবছি!"চোখ সরু করে কোমরে হাত দিয়ে তীব্র অভিমানে তাকায় পিকু।
"মানে ভাবছি সংসার চলবে কি করে"
"অ্যাই একদম কথা ঘোরাবে না। তুমি নিশ্চয় রিপেন্ট করছো তাই না? হ্যাঁ মাত্র দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করে এই অবস্থা?"
"আরে বাবা এসেই ঝগড়া করোনা তো।"
"আমি আবার ঝগড়াও করি!"জলের বোতল থেকে বেশ খানিকটা জল খেয়ে হাতের উলটো চেটোতে মুখ মুছে পিকু বলল,"মাস দুই এ এই অবস্থা এখনও সারা জীবন বাকি।"
"দাঁড়াও দাঁড়াও আগে কাজের কথা সারি। বাবার শরীর টা ঠিক নেই। ভাবছি অ্যাডমিট করে একবার চেক আপ করে নি?"
"কেন কি হয়েছে?"
"আরে হার্টের প্রবলেম তো ছিলই এখন আবার শ্বাস কষ্ট বেড়েছে, সুগার ফল করেছে।'
"তাহলে?"
"তোমাদের হসপিটালে অ্যাডমিট করে দিই। তুমি আছো অবসারভ করতে পারবে।"
"সে করে দাও কিন্তু আমিতো নিউরোর, হার্টে ডিপার্টমেন্টের মিস্টার কাজোরিয়ার আন্ডারে এডমিট করে দাও। তারপর আমি না হয় অবসারভেশনে রাখব এটুকুই ট্রিটমেন্টের ওয়েগুলো তো আমার জানা নেই।"
"চেনাজানা থাকলেও তো শান্তি।"
(৫)
অপূর্ব চ্যাটার্জী মানে আলেখ্যর বাবাকে অ্যাডমিট করা হলো তার দুদিন পর। আলেখ্য তখনই আলাপ করিয়ে দেয় মুখোমুখি বাবা মা এর সাথে পিকু কে। নীচে এসে রিসেপশনে সমস্ত নিয়মকানুন বুঝে নিচ্ছিলো আলেখ্য। আলেখ্যর মা নিরুপমা দেবী বসেছিলেন একপাশে চেয়ারে।আর কেবিনে অপূর্ব বাবু নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিলেন পিকুর দিকে।আর ফিরে যাচ্ছিলেন অনেক অনেক বছর আগে।এই মুখটা কার! বহু বহু যুগ আগে চেপে থাকা চাপা পড়ে যাওয়া অথচ প্রতিনিয়ত মনের ভেতর উঁকি মারা একটি মুখের প্রতিচ্ছবি যেন। নিজের শারীরিক অবস্থার কথা ভুলে পিকুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বিস্ফারিত চোখে। আলেখ্য এডমিট করে চলে গেলে পিকু রাতে ফিরে যাবার আগে আসে অপূর্ব বাবুর কাছে ,"কোন প্রবলেম হচ্ছে না তো আঙ্কেল?"
অপূর্ববাবু চোখ বন্ধ করে চোখ ধরে বিস্মৃত যন্ত্রণা রোমন্থন করছিলেন তখন। বট গাছের ঝুরি, কপালের ক্ষত, ময়না নদীর ধার, খুকুর চুলের গন্ধ, পাতলা ঠোঁট কত কিছু মনে পড়ে যাচ্ছিল। চোখ মেলে তাকালেন পিকুর দিকে,"তোমার বাড়িতে কে কে আছে?"পিকু অবাক হলো একটু," মা ,জেঠু মনি, জেঠিমা।"
"তোমাদের কেউ বাংলাদেশ খুলনায় থাকতো চারুলতা?"
"মা থাকতেন, কেন বলুন তো?"
অপূর্ববাবু এক ঝটকায় সমস্ত শারীরিক প্রতিবন্ধকতা অস্বীকার করে উঠে বসার চেষ্টা করলেন,"কি নাম বলতো?"
"বনানী, বনানী রায়"
"খুকু!!!"
" কি করছেন!এত উত্তেজনা ভালো নয়! "একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করল,"আপনি চেনেন মাকে?"
অপূর্ববাবু আবার শুয়ে পড়লেন, পাশ ফিরলেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে চোখ দিয়ে অবিরত জল গড়িয়ে পড়ছে।
"সিস্টার সিস্টার "চিৎকার করে পিকু ডঃ কাজোরিয়াকে ফোন করো একবার। পিকু অপেক্ষা করলো যতক্ষণ না অপূর্ব বাবুর অবস্থা স্থিতিশীল হয়। অবস্থা যখন আয়ত্তাধীন তখন কাছে এসে দাঁড়ালো পিকু। অপূর্ববাবু কোনরকমে তাকালেন ইশারায় ডাকলেন কাছে পিকু কে,"মাকে বলো বাবাই দা একবার দেখা করতে চেয়েছে।"
(৬)
একটা বড় ঝড় এলে যেমন তছনছ করে দেয় সমস্ত সাজান প্রাকৃতিক সংসার ,তেমনি যখন এসে বলেছিল 'মা তুমি বাবাইদা বলে কাউকে চেনো?'বনানীর বুকের অন্তঃস্থলে তেমন ঝড় উঠে
সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল অতীত বর্তমান, ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছিল।
তবু ফ্যাকাসে বিবর্ণ মুখে বলেছিলেন,"হ্যাঁ কেন?"সঙ্গে সঙ্গে ভাবছিলেন ছোটবেলার ডায়েরিটা ট্রাঙ্কের অনেক নিচে লুকানো সেটা কোন ভাবে পিকু পায় নি তো।
"তোমাকে আলেখ্যর কথা বলেছিলাম না, ওর বাবা মানে অপূর্ববাবু হসপিটালে এডমিট হয়েছে উনি বলছিলেন ,অবস্থা খুবই খারাপ! অনেকগুলো ব্লকেজ আছে কিভাবে সার্ভাইভ করবেন জানিনা, আলেখ্য ওঅবশ্য জানে না ব্যাপারটা।"
ঝনঝন করে হাত থেকে পড়ে গেছিলো হাতে ধরা কাঁচের গ্লাসের জুস আর কফির কাপ সহ ট্রে।
"কি হয়েছে মা ?তুমি চেনো ওনা কে?"
বনানী দেবী উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন ।বহু ডাকাডাকির পর অনেকক্ষণ বাদে যখন দরজা খুললেন তখন অনেকটা ঝড়ে বিধ্বস্ত নীড় হারা পাখির মত লাগছিলো মাকে। এতটা কঠিন কখনো দেখেনি তার মাকে কৌতুহল চাপতে না পেরে খাটের উপর ফেলে যাওয়া পান্ডুলিপির মত ডায়রির পাতায় লুকানো ছবি এবং লেখা গোগ্রাসে গিলেছিল পিকু। পড়তে পড়তে চোখে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল তার এত যন্ত্রণা লুকানো ছিল না মায়ের মধ্যে! মানুষটা কি পেল সারা জীবনে? কখনো তো বুঝতে দেয়নি, বাবা ও ছেড়ে চলে গেছে বহুদিন আগে ,সে নিজেও কি পেরেছে মাকে সঠিকভাবে বুঝতে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মায়ের কষ্ট অনুভব করতে করতে যখন কেঁদে ফেলেছিল তখন মা বাইরে ডাইনিং থেকে ডেকেছিল "খেতে আয়" তাড়াতাড়ি ডায়েরি আর ফটো লুকিয়ে ফেলেছে পিকু।
(৭)
মনের ইট পাথর গুলো কে জমা করে এক জায়গায় শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে পিকুর সাথে বনানীদেবী এসে যখন দাঁড়িয়েছিলেন অপূর্ববাবু সামনে অপূর্ববাবু তাকিয়েছিলেন খুকুর কপালের কাটা দাগ এর দিকে। বনানী অপূর্ববাবু মুখের সামনে ঝুঁকে পড়লেন "কেমন আছো বাবাই দা?"
"বকুল ফুল তুমি চলে গেছিলে!"
অলিন্দ ও নিলয়ের রক্ত যেন খরস্রোতা নদী। তবু শান্ত হয়ে বনানীদেবী চোখ বন্ধ করে বললেন, "এখন এসব কথা থাক বাবাইদা ,তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো।"
"আমি তো কবেই অথর্ব হয়ে গেছি খুকু।"
বনানীদেবীর মনে হলো মাঝের এতগুলো বছর কেটে বাদ দিয়ে দেন ,সেই ময়না নদীর ধারে বটগাছের ছায়ায় গল্পে মেতে উঠুক শুকসারির মত। পুরনো সময় কে মুঠোর মধ্যে ধরে ফেলে। অসহায় , অসহায়, সময়ের কাছে পৃথিবীর কাছে,পরিস্থিতির কাছে মানুষ অসহায়।
"সুস্থ হয়ে ওঠো!"
"আর ফিরবো না জানি খুকু ,মরনেওআজ আর খেদ নেই শেষ ইচ্ছেটা ভগবান শুনেছেন পৃথিবীটা সত্যিই মনে হচ্ছে গোল এখন খুকু ,নিরুপমার সাথে আমি অন্যায় করেছি জানি, কিন্তু কাউকে ভালোবাসাটা তো অন্যায় নয় ,ভালোবাসা তো মরে না ,ভালোবাসা ফুরিয়ে না গেলে আমি কি করবো?"
দুজনে নিশ্চুপ ভাবে হাত ধরে বসে থাকে বহুক্ষণ ব্যাপী, সমস্ত সময় যেন থমকে যায় এক পলকে, ঘড়ির সময়ের সাথে মনের সময় মিলতে পারে না কিছুতেই।
ধীর পায়ে নেমে আসেন ওয়েটিংরুমে বনানী দেবী,কাছে বসেন নিরুপমা দেবীর।
নিরুপমা দেবী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন অবাক হয়ে,"আপনি খুকু?"
"মানে আপনি আপনি কি করে জানলেন!"
"অপূর্ব আমায় কিছু জানায়নি জানেন, একসময় ওর ডাইরি থেকে জেনেছি সবটা ,ধরাও পড়েছি, ঈর্ষা করতাম আপনাকে খুব, ঈর্ষা হত অচেনা অদৃশ্য অথচ সবসময় দৃশ্যমান আপনার ওপর। উনি তারপর বোঝান হিংসা করলে শুধু নিজের ক্ষতি হয়, সময় পেরিয়েছে হিংসেটা কখন নিভে গেছে তারপর আগুনের মত ,একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কি পরিমান ভালবাসলে মন খারাপ হলে আপনার ছবি দেখতেন রাতে কোন কোন দিন আড়ালে,তখন বুঝলাম সারা জীবন জোর করে আর যাই পাওয়া যাক ভালোবাসা পাওয়া যায় না।তবু মনে হতো কেন শুধু বঞ্চনা দেওয়ার জন্য,অন্য একজন কে মাঝে রেখে তৃতীয় ব্যক্তির মত সারা জীবন ব্যবহার করলেন আমাকে ,কেন ই বা কাছে এলেও কখনও আমার করে পাই নি তাঁকে,তবু টুবান এসেছিল।টুবান না এলে আমি বোধ হয় সম্পর্ক টা টানতে পারতাম না। ভিতর জ্বালা টা কখন নিবে গেছে। যা পাইনি তার জন্য দুঃখ হয় না, যা পেয়েছি সেটুকুই অনেক সবকিছু কি আর জোর করে পাওয়া সম্ভব?"
বনানী দেবী বলেন, "ক্ষমা করুন আমায় ,বিশ্বাস করুন কখনো তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে আমি আপনাদের সম্পর্কে নতুন করে আসতে চাই নি, শেষ জীবনে এসে টানাহেঁচড়া করে সম্পর্কের সমীকরণগুলো পাল্টাতে চাই নি কখনো।"
"এই জন্যই বোধহয় আপনাকে আজও ভালোবাসেন উনি"নিরুপমাদেবী উঠে এসে জড়িয়ে ধরেন তাকে। একটি বিন্দুতে এসে দুটি ভিন্ন সরলরেখা আর একটি সরল রেখাকে ঘিরে ত্রিভুজ তৈরি করে।
আলেখ্য নেমে আসে বাবার কেবিন থেকে, এতক্ষণ সমস্ত ঘটনা চোখের সামনে অবিশ্বাসের মত লাগছিল পিকুর। আলেখ্য কে নিভৃতে নিজের চেম্বারেনিয়ে গেল পিকু।
"কি হলো এখানে নিয়েএলে? এনিথিং সিরিয়াস?"
"আমাদের বিয়েটা এবার সেরে ফেলতে হবে আলেখ্য।"
"মানে? বাবার কি সিরিয়াস কন্ডিশন?"
"আঙ্কেলের অপারেশন হয়ে গেলেই রেজিস্ট্রি করে রাখব আমরা।'
'হঠাৎ?'
'মানে আর একটা ত্রিভুজ কোন ভাবেই যেন না তৈরি হয় ,ডিলে করলে চলবে না।"
"কি ত্রিভুজ চতুর্ভূজ করছো,কিছুই বুঝতে পারছি না।"
"আমাদের তাড়াতাড়ি বিয়ে করার কথা বলছি গাধা একটা।"
আলেখ্য আড়চোখে তাকিয়ে বলে,"ভুতের মুখে রাম নাম!"
নাহ আজ আর পিকু আলেখ্যর পিঠে সজোরে কিল বসায় নি ,আলতো করে পিছন দিক থেকে মাথাটা পিঠে ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল।।
2 Comments
মনকে নাড়া দেওয়ার মতো একটি অসাধারণ গল্প। সময়ের মুখোমুখি আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হয় এভাবেই, কখনো হিসেব নিতে, আবার কখনো বা হিসেব দিতে। চমৎকার উপস্থাপন।
উত্তরমুছুনমনকে নাড়া দেওয়ার মতো একটি অসাধারণ গল্প। সময়ের মুখোমুখি আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হয় এভাবেই, কখনো হিসেব নিতে, আবার কখনো বা হিসেব দিতে। চমৎকার উপস্থাপন।
উত্তরমুছুন