সমাজ বসুর গল্প



ব্রিফকেস

আজকাল খবরের কাগজ পড়তেও তেমন ইচ্ছে করে না সুবিমলের। পাতার পর পাতা সেই একই খবর। আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সুস্থতাও। তবু যেন এক অস্থিরতা চিন চিন করে বেজেই চলেছে বুকের ভেতর।  অদ্ভুত এক অজানা আশংকা সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁকে।
       
বিশাখারও তো বয়স হয়েছে। সংক্রমণের ভয়ে আজ প্রায় পাঁচ মাস হতে চলল, কাজের দিদি আসছে না। দুজনের ছোট সংসার। তবু অনেক কাজ। সেই সকাল থেকে উঠে শুরু হয়। দুপুরের দিকে খানিকটা গড়িয়ে আবার বিকেল থেকে  রাতে শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত শুধু কাজ। সুবিমল কতবার হাতে হাতে কিছু করার জন্য এগিয়ে গেছে কিন্তু কুটোটা নাড়তে দেয়নি তাঁকে। শুধু বিছানার দায়িত্বটা তাঁর কাঁধে। এই এক জায়গায় বিশাখার অনীহা। বিয়ের পর থেকেই। এখন যা অবস্থা,মেয়ে যে এসে দু'টো দিন থাকবে তারও উপায় নেই। মাসে দু একবার কোনরকমে জামাইকে নিয়ে আসে। সন্ধ্যেটুকু কাটিয়ে চলে যায়। ওই অল্প সময়েই রাতের একটা ডিশ তৈরি করে রেখে যায়।
      
খবরটা গতকাল শোনার পর থেকেই সুবিমল ভীষণ দমে গেছে। নিজের ভেতর নিজেকে শামুকের মত গুটিয়েও যেন অস্বস্তি কাটছে না। চিন্তায় চিন্তায় কাল রাতে ঘুমটাও ঠিক মত হয়নি।
      
পাড়ার দোকানে পাউরুটি আনতে গিয়ে খবরটা পেয়েছে। বিশাখাকে কিছুতেই বলা যাবে না। ভীষণ ভয় পেয়ে যাবে। মনোময়ের করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে। বছর দেড়েক হল দুজনে একই দিনে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। সমসাময়িক বয়সের বন্ধুত্বে একটা আলাদা টান থাকে। দিন চারেক আগে পাড়ার দোকানেই দেখা হয়েছিল। এতটুকু আঁচ করতে পারেনি সুবিমল। মনোময়ও কি বুঝতে পেরেছিল?

--- শালা এই করোনা প্রাণ ওষ্ঠাগত করে ছাড়ল,মাইরি। হারামজাদা কবে যে বিদায় নেবে কে জানে। কথায় কথায় গালাগাল দেওয়া মনোময়ের স্বভাব। কালপাত্র কিছুই মানে না।

--- তা কি আর করা! একে নিয়েই ঘর সংসার করতে হবে। তৈরি হও মনোময়। আর তোমার এই রোজ রোজ বেরনোটা বন্ধ করো।

--- দ্যাখো বাপু সুবিমল, করোনা কেন,ওর চোদ্দ গুষ্টি এলেও আমার ছিড়তে পারবে না।

--- মুখে লাগাম দাও। হাজার হোক বয়স তো হচ্ছে। এরপর ছেলের বিয়ে দেবে। নাতি নাতনি আসবে। তখন?

--- তখন দেখা যাবে। কথা শেষ করেই মনোময়ের উদ্দাম হাসি। সেই হাসি ঝলমলে মুখটা আজ ভীষণ ভাবে মনে পড়ছে সুবিমলের। এমন এক বেপরোয়া, প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছে নিমেষের ভেতর। মুকুন্দপুরে এক নার্সিংহোমে চিকিৎসা চলছে। একমাত্র ছেলে বাইরে। কোনোভাবেই আসতে পারছে না। স্ত্রী সম্পূর্ণ একা। হোম কোয়রান্টিনে আছে।

কালো বেড়ালের মত নিঃশব্দে চুপি চুপি সময়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে ভাইরাসটা ঘাপটি মেরে বসে থাকে শরীরের এক কোণে। তারপর সময় বুঝে সারা শরীর তোলপাড় করে দেয়। আস্তে আস্তে উপসর্গ শুরু হয়। ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায় না। মনোময় কি উপসর্গগুলো গোপন করেছিল? মনোময়ের মত তারও যদি হঠাৎ পজিটিভ ধরা পড়ে? ভাবতেই পারে না সুবিমল। একটা ভয় লাউডগা সাপের মত তার চিন্তাকে জড়িয়ে ধরে। বিশাখার কি হবে? জীবনের সব চাওয়া পাওয়া,সব খতিয়ান নিমেষে শেষ হয়ে যাবে। মনে মনে একটা সমাধান খোঁজে সে।
      
দুদিন পর ঝিনুকের জন্মদিন। তিরিশে পা দেবে মেয়েটা। মনে হয় এই সেদিনের কথা। নার্সিংহোমে বিশাখার পাশে বেবিকটে শুয়েছিল। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। ঢলঢলে চোখ মুখ। ভাল করে তাকিয়ে দেখেছে সুবিমল,মুখটা তারই মত। গায়ের দুধেআলতা রঙ অবশ্য মায়ের দিকেই ঢলেছে। বড় স্নেহ মায়া আর আতিশয্যে বড় হওয়া মেয়েটা আজ শ্বশুরবাড়িতে খুব ভালই আছে। সোহমের মা বাবা তো মেয়েটাকে চোখে হারায়। তাঁরাই ঝিনুককে পরশু দিন সাতসকালে ঠেলে পাঠাবে। সুবিমল মনে মনে ছক কষে নেয়। এই দুদিনেই একটা কিছু করতে হবে। এইসময় জীবনের কোন ভরসা নেই। হাজার সতর্কতার বেড়া ভেঙে অসুখটা ঢুকে পড়ছে বিনা নোটিশেই। 
        
রাতে খাওয়ার পর ক্লান্ত বিশাখা শুয়ে পড়তেই নিঃশব্দে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সুবিমল। তারায় সাজানো ঝকঝকে আকাশ। দশমীর চাঁদ ভাসছে। দূরে আকাশছোঁয়া আবাসনগুলোর বিন্দু বিন্দু আলো। চরাচর জুড়ে শুধুই নিস্তব্ধতা।এত নিস্তব্ধতা সে আগে কখনো দেখেনি। জীবনটা খুব পলকা লাগছে তার কাছে। একরাশ মনখারাপের চাদর জড়িয়ে ঘরের ভেতর পা রাখে। বিশাখার দিকে একবার তাকায়। বড় মায়া হয় তার। ভাবে একবার ডেকে সব বলবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়,না থাক্,এতবড় নিষ্ঠুর সত্যিকে সে মেনে নিতে পারবে না। বিশাখা হয়ত এইসময় ক্রান্তিকাল পেরনো কোনো এক সুন্দর সকালের স্বপ্ন দেখছে। দেখুক, ঘুম ভাঙাবে না। খুব সন্তর্পনে আলমারি থেকে ব্রিফকেসটা বের করে আনল সুবিমল। তারপর একে একে প্লাস্টিকের ফাইল কভার। এইগুলোর ভেতরেই বন্দী আছে সব হিসেব নিকেশ। জীবনধারন আর জীবনযাপনের যাবতীয় নথিপত্র। কর্তব্য, দায়বদ্ধতার খতিয়ান। ফিক্সড ডিপোজিটের কাগজপত্র, কর্পোরেশনের পেপার, কিছু শেয়ারের কাগজ আর মেডিক্লেমের দলিল। সব,সবগুলো থরে থরে সাজিয়ে ব্রিফকেসটা বন্ধ করে একটা শান্তির প্রশ্বাস নিল সুবিমল। আর কোন ভয় নেই। চিন্তাও নেই। তার অবর্তমানে কোথায় হাতড়িয়ে বেড়াত বিশাখা?অথচ বিশাখার প্রতি তার এতটুকু ফাঁকি নেই। তার বিন্যস্ত জীবনের ছবি সে অনেক আগেই এঁকে রেখেছে। সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে। কিন্তু বড় অসময়ের এই যাওয়া।বড় অপ্রত্যাশিত। তাই এত প্রস্তুতি। এত আয়োজন। পরশু দিন ঝিনুক আর সোহমের হাতে ব্রিফকেসটা তুলে দিতে পারলেই নিশ্চিন্তি। তারপর মহাপ্রস্থানের পথে যেতে হলে অনেক নির্ভার যেতে পারবে সুবিমল।

  সাহিত্যিক সমাজ বসু 
৫৬এ, মিলন পার্ক, গড়িয়া, কলকাতা



















0 Comments