দেবীপক্ষ
ছোট্ট টুসকি'র তর সয় না, ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে বারবার খোলা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবাই আর মামমাম শপিং করতে গেছে কখন, কত কী আনবে তার জন্য, সুন্দর ড্রেস, সফ্ট টয়, কুকিজ, আরও কতকিছু! তার ঠাম্মা আর দাদু আসবে ক'দিন পরেই, সবাই মিলে প্রতিবছর বেড়াতে যায় ওরা। এবছর তো প্যান্ডেমিক, তাই কোথাও যাওয়া হবে না, এই কমপ্লেক্সে'ই যতটা হয়! তবু তো দুর্গাপুজো, কী আনন্দ হয়, ঠাম্মা কতরকম নাড়ু বানায় আর কুচো নিমকি, বেশি করে ময়ান আর কালোজিরে দিয়ে!
পুজো'র মাসে ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকবে, অরণ্য'র সাথে দেখা হবে না তিয়াসা'র। প্রফেসর সেন কোথাও বিদেশ যাচ্ছেন সেমিনারে, নোটস আনতে যাবার নাম করে বেরোনোও যাবে না, ওই একসাথে কখনো পার্কে'র বেঞ্চ, শপিং মলে'র সামনের স্টল বা বাইকে এক চক্কর এইটুকুই তো মুক্তি'র আকাশ, মন ভালো নেই তার। আত্মীয়স্বজন, দিদি, পিসি, পুঁচকেগুলোতে ঘর ভরা থাকবে, নিজের বেডরুমটাও ছেড়ে দিতে হয় তখন, একটু কথা বলারও কি প্রাইভেসি থাকবে? ওর মোটেও ভালোলাগবেনা, সেজেগুজে বাড়ির লোকের সাথে ঠাকুর দেখতে!
একটু দম ফেলার ফুরসত নেই তরুণী কোয়েলী'র। অভি'র অফিস নেই তো কি হয়েছে? পিসশ্বশুরেরা এবার আসছেন চন্দননগর থেকে, শাশুড়ি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন,
—বছর বছর, নেচে নেচে, বাপের বাড়ি চলে গেলে তো হবে না, আমার বয়েস হয়েছে, আত্মীয়স্বজনরা আসবে, কে করবে তাদের খাতির-যত্ন?
অগত্যা...
মা বলেছিলো,
—তোর জন্য একটা লালপেড়ে গরদ কিনেছি, অঞ্জলিতে পরিস,বেশ মানাবে তোকে।
অভি'র কাছে বলতে গেলে পাশ কাটায় সে,
—মেয়েদের তো এগুলো মেনে নিয়েই বিয়ে থা করতে হয়! না'হলে তোমার কি মনে হয় কোয়েলী, আমি চাকরি-করা মেয়ে পেতাম না?!
আড়ষ্ট কোয়েলী পাশ ফিরে ঘুমন্ত তিনবছরের শিশুকন্যা'র দিকে যতটাসম্ভব গড়িয়ে যায়।
—আহা! আঁশে'র ছোঁয়া কাপড়ে ঠাকুরের নাড়ু করবে কি গো বৌমা? বিজয়াদেবী বউ-মেয়েদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এতবছর ধরে চৌধুরীবাড়িতে তিনিই সামলে রেখেছেন সব দিক। লোক-লস্কর, ছেলেপুলে, আত্মীয়স্বজন সবার সুবিধা-অসুবিধা'র দিকে তীব্র দৃষ্টি তার। ঠাকুর-চাকরেরা অবধি তাকে 'মা' ছাড়া কথা বলেনা। সেই এগারো বছর বয়েসে এসেছেন এ বাড়িতে, এখনো।পাকাচুলে সিঁদূর পড়ে, কস্তা-পেড়ে শাড়িতে তাকে দেবী'র মত মনে হয়। ঠাকুরের একশ' আটখানা পদ্ম, নৈবেদ্য, ভোগের জোগাড়-যন্ত, তারপর দেওয়া-থোয়া তো আছেই, সবকিছু সুচারুভাবে হলে তবে শান্তি। এর মধ্যে দিয়ে কবে কখন ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে গেছে তার যৌবনের সোনালি দিনগুলো তা টেরই পাননি, বিসর্জনে'র পর ফাঁকা মন্ডপে যখন প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন, মনে পড়ে তার কর্তামশাই তখনও বাইরে বাইরে, চিরদিন বিজয়াদেবী পুতুল খেলেছেন বুঝি?! ছেলেমেয়ে, সংসার আর বিষয়-আশয় নিয়ে! উনি নিয়মিত বন্ধুবান্ধব, নিজস্ব বৃত্তে মশগুল থেকেছেন,লোকে বলাবলি করে, বাগান-বাড়িতে নাকি রাতে এখনো...
ছেলেমেয়েরা ফিরে যায় যে যার, পুজো ফুরোলে, আটচালায় কাঠামো'টা আর সে একা পড়ে থাকে এতবড় বাড়িতে!
সন্ধেবেলা'র মুখে বাড়ি-ফেরত, একঝলক ছাতিমে'র গন্ধ এসে ঝাপটায় নাকে! আহহহহহহহ... বুক ভরে শ্বাস নেয় সাহানা, ছাতিমে'র গন্ধ তার বড় প্রিয়। পুজো এবছর দেরীতে, তাই ফুটতে শুরু করেছে। ছাতিমের গন্ধে'র সাথে মনে পড়ে যায় কত পুরনো শিশিরভেজা গল্প, শিউলীসতেজ দিন, নষ্টালজিয়া'র নাক উঁচু করে, অনির্বাণে'র কথা,হাসি, স্মৃতি'র এলব্যামে ভেসে ওঠে। একই শহর অথচ যোজন দূরত্ব, ওর ফ্ল্যাটের দিকে তাকাতে এই মধ্যবয়েসে স্পন্ডেলাইটিস হওয়া ঘাড়, ব্যথা করে সাহানা'র, ক্ষয়ে আসা হাওয়াই চটি'র দিকে চোখ নামিয়ে নেয় সে। এমন ছাতিমফোটা দিনেই তো সে প্রথম দেখেছিল অনির্বাণ'কে, একটা নৌ-নীল শার্ট পরে। যাতায়াতের পথে কোনোদিন এক-আধবার চোখেও পড়ে যায়, সে খেয়াল করে না তেমন, নির্ভার দামী জীবনের একটা তীব্র উদাসীনতা আছে, যার জীবন সে বোঝেনা, আশেপাশের মানুষ বেশ অনুভব করে।পুজো এলে সেইসব দিনের কথা খুব মনে পড়ে,সাহানা ঠিকই দ্যাখে, মধ্যবয়সী পুরুষ, একটু কি রোগা হয়েছে আগের চেয়ে? একমাথা কাঁচাপাকা চুল, চোখদুটো একইরকম উজ্জ্বল আছে এখনো। কষ্ট করে যদি চিনতে হয়, সেই ভয়ে কোনোদিন আর সামনে যাবার ইচ্ছেটা মরে গেছে, তা না হলে বড় জানতে ইচ্ছে করে, অদ্ভুত সুন্দর সেই সন্ধেবেলাগুলোতে যখন তারা সারাদিনের অপেক্ষা'র পর একটা অনুজ্জ্বল হলদে আলো'র নিচে দাঁড়াতো, পৃথিবী'র শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ মনে হত তাদের, একথা কি অনির্বাণ ভুলে গেলো? এত তাড়াতাড়ি? পুজোর গন্ধ ছাপিয়ে ছাতিমে'র আঘ্রাণ তীব্র হয়ে ওঠে।
সে অপেক্ষা করে। সারাবছর বাড়ি'টার সাথে যাপন, ঘর, উঠোন, বাগান। তার নিজের হাতে তৈরী বসতভিটে, উনি চলে যাবার পর ছেলেরা নিয়ে যেতে চেয়েছিল। জ্ঞাতিগুষ্টি, আত্মীয়স্বজনরা বলেছিল,
—দু দুখানা ছেলে পেটে ধরেছ গো, দুটিই রত্ন,বুড়ো বয়েসে আর ভিটে আগলে থাকা কেন বাপু? একটু যত্ন-আত্তি পাবে, যাও ছেলেদের কাছে থাকোগে।
সে পারেনি, এই বাহাত্তর বছর বয়েসেও কিরণমালা'র মন পড়ে থাকে ঠাকুরঘরে, ভেজা বারান্দায়, উঠোনের ঘাসে, বাগানে'র পাতা পড়ায়।ব্রাহ্মণ- বিধবা মানুষ, একাহারী। শরীর ভেঙেছে অনেকদিন, শুধু মনে তীব্র বিশ্বাস বেঁচে আছে, পুজো এলে ছেলেরা ঘরে ফিরবে। প্রায়ান্ধকার রান্নাঘরে ধোঁয়া'র ভেতর, পেতলে'র কড়াইয়ে সিমুই নাড়তে নাড়তে চোখ জলে ভরে যায়, ছোট'টা আজই ফিরে যাবে, নাড়ি টনটন করে ওঠে। ছেলে তার সিমুই খেতে খুব ভালোবাসে।কোলে'র ছেলে তো, আলাদা টান! ফিগার কনশাস ছেলে আঁতকে ওঠে,
— এ তো দারুণ মিষ্টি, প্রচুর ক্যালোরি! এক চামচ খেয়ে সরিয়ে দেয়।
ধুলোভরা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে এক মা, হাজার মায়ের প্রতিভূ হয়ে, ছেলের গাড়ি'র লাল আলো মিলিয়ে গেছে কখন, বাটিভর্তি সিমুইয়ে জল ঢেলে দ্যায় মা।
মিনু'র মা পাঁঁচবাড়ি গতর খাটায়,মাগনা কেউ কিছু দেয়না আজকের বাজারে, সেই ভোর থেকে রাত অবধি খেটেখুটে তবে দুবেলা ভাতের যোগাড়! ঘরের মানুষ'টা স্টেশন-বাজারে ভ্যান টানে, সন্ধে-ইস্তক নেশা-ভাঙ করে, এতগুলা ছেলেপুলে'র মুখে নুন-ভাত জোটাতে হাড়-হিম হয়ে আসে। বড় মেয়েটা'কে পনেরো পেরোতে না পেরোতে বিয়ে দিয়ে দিলো ওর বাপ-জেঠা'রা। আপত্তি করেছিল মিনু'র মা।
—ছোটলোকের ঘরে গতর খাটিয়েই খাবে যদি বিয়ে ক্যানে তবে একন? কাঁচা শরীল।
ওরা কথা শোনেনি। সে মেয়েকে আজ তিনবছর বাপের ঘর পাঠায়নি শ্বশুরবাড়ি'র লোক। মেয়ে আটমাসের পোয়াতি। অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছে মিনু'র মা, এবার টাকাক'টা ওর শাউড়ি'র হাতে গুঁজে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে আসবে সে। একখানা কাপড়'ও কিনেছে মেয়ের জন্য রেশনের দোকান থেকে। ষষ্ঠী'র সকালে মেয়েকে আনতে গিয়ে দ্যাখে মেয়ে তার স্বামী'র ঘরে নেই। জ্বরজারি হয়েছিলো, ওষুধ ডাক্তার করেনি, ভরা-পেটে পুকুরঘাটে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মেয়ে'র যমে-মানুষে টানাটানি, ফিমেল-ওয়ার্ডে'র আয়া মিনু'র মা'র বাপের বাড়ির দেশের চেনা। সে বললে,
—ধড়ফড়িয়ে মরা'র আগে পর্যন্ত মেয়েটা মা মা করেছিল গো।
মিনু'র মা আজকাল ঘাড় গুঁজে খাটে, পুজো-পাব্বনে বাড়ি থেকে বেরোয় না বড় একটা।
এই দেবীপক্ষে অসংখ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানবী'কে তুমি দেবী'তে উত্তীর্ণ কোরো মা, জ্ঞান ভক্তি তো আপেক্ষিক, ওদের তুমি একটা হৃদয় দিও ভালোবাসা'র, একটা কপাট বুক দিও মাথা রেখে কাঁদা'র, দিনে'র শেষে অনুজ্জ্বল আলোতেও দুটি চোখ দিও জুড়োবার। ওরা, এর বেশি কিছু চায়'না। তুমি'ও তো মেয়ে মা'গো, ঠিক বুঝবে তুমি।
0 Comments