বাণ-মোচন
“তখন পাড়া-গ্রামে একটা রীতির চল ছিল খুব বেশি। যখন কোনো মানুষের কারুর উপর রাগ মেটানোর থাকত, বা প্রতিশোধ নেবার থাকত – তখন সে কোনো এক ওঝা বা গুণীণ-এর সাহায্য নিয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বাণ মেরে দিত। না, এখানে ‘বাণ’ বলতে ঠিক ‘তীর’ নয়, সেটি হল কোনো অপার্থিব জিনিসের দ্বারা প্রেরিত কোনো অভিশাপ – যেটি উক্ত ব্যক্তির ক্ষতিসাধন করত। এই গোটা ব্যাপারটা কতটা সত্যি আর কতটা বুজরুকি – তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে এমনই একটা গল্প শুনেছিলাম আমার খুব কাছের একজন মানুষের কাছ থেকে, যে তার নিজের সাথে ঘটা ঘটনাটি আমাকে শুনিয়েছিলেন।” –এতটা বলে বটুকবাবু চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
“আপনি যখন মনেই করেন ওটা বুজরুকি, তাহলে আর আমাদের শোনাচ্ছেন কেন? আপনি যে বলেন - প্রমাণ না পেলে আপনি কিছু বিশ্বাস করেন না?” –জগন্নাথ বলল।
বাকি সকলে ধমকে চুপ করিয়ে দিল জগন্নাথকে।
বটুকবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুরু করলেন-
আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া শিপ্রা পিসি, বাগুইহাটিতে থাকতেন। আমায় খুব স্নেহ করতেন উনি। ছোটোবেলায় প্রতি গরমের ছুটিতে ওনার বাড়িতে গিয়ে থাকতাম, আর উনি প্রতিদিন দুপুরে আমাকে বিভিন্ন রকমের গল্প শোনাতেন। সেই সময়কালেই শুনিয়েছিলেন এই গল্পটা। ওনার নিজের সাথেই ঘটা একটি ঘটনা।
ঘটনাটা ওনার বারো কি তেরো বছর বয়সের। একদিন শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ অনুভব করেন - ওনার প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুকের উপর যেন ভারী কিছু জিনিস চেপে রয়েছে! কখনও শ্বাস নিতে গিয়ে দম আটকে যাচ্ছে, আবার কখনও শ্বাস ফেলতে গিয়ে দম আটকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন কিছুক্ষণ বাদে বাদে কেউ তাঁর গলা চেপে ধরছে! তাঁর বড়ই করুণ অবস্থা তখন। এতই কষ্ট পাচ্ছেন যে তা চোখে দেখলে মায়া লাগে, চোখ থেকে জল বেরিয়ে যায়! শিপ্রা পিসির বাবা-মা তাঁকে কাছেই এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হল না। তিনি হাসপাতালে ভর্তি করতে বললেন। তাও হল। কিন্তু তাতেও অবস্থার খুব একটা উন্নতি হল না। অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে রাখতে হচ্ছিল সারাক্ষণ। এরপর বহু ডাক্তার, কবিরাজ, এমনকি ওঝার কাছে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। দিনে দিনে রোগ বেড়েই যেন চলে। খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া মেয়ে পড়াশুনা ডকে তুলে দিয়ে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে পুরো। শিপ্রা পিসি ছাড়া ওনার মা-বাবার দ্বিতীয় কোনো সন্তান নেই। ওনারা পিসিকে ভালও বাসেন প্রচন্ড। চিন্তায় ওনাদেরও যেন ঘুম উড়ে গেছে ওই ক’টা দিনে। পিসিকে নিয়ে কি করবেন, কোথায় যাবেন - তার দিশা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তাঁরা। এমনই সময় দেবদূতের মত তাঁদের জীবনে আবির্ভাব হল তাঁর। হিমাদ্রী সাধু, ঠিক মহামানবের মত পিসিকে এই বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করতে আবির্ভূত হন।
পিসিদের পাড়াতেই একটা বারোয়ারী কালী মন্দির ছিল। সেখানেই আসতেন হিমাদ্রী সাধু। লোকে বলে তিনি নাকি কোনো জমিদারের বংশধর। অবশ্য তার চালচলন, কথাবার্তায় আভিজাত্যের ছাপও প্রচন্ডভাবে ফুটে উঠত। ছয় ফুটের বেশি উচ্চতা, গৌড় বর্ণ, টিকালো নাক, তেজস্বী স্বর, মাথায় এত্ত বড় জটা, শিষ্যদের দেওয়া দামী মখমলের কাপড়, আর কাঁধে একটি ঝোলা ব্যাগ – এ’সবের সমাহারে তাকে মানাতও দারুণ। আশেপাশের মানুষজন তাঁকে শ্রদ্ধাও করতেন খুব। তবে, জমিদারি ছেড়ে উনি কেন যে তন্ত্রসাধনায় নিজেকে নিমজ্জিত করলেন তা সকলেরই অজানা। প্রতি অমাবস্যাতে মন্দিরের কালী মা-কে পুজো করতন। পুজোর সময় দামী কাপড় ছেড়ে শুধুমাত্র একটি লাল রঙের কটিবস্ত্র ধারণ করতেন। ছুড়ি দিয়ে হাত কেটে নিজের রক্ত দিয়ে তুষ্ট করতেন তিনি মায়ের চ্যালা-চামুন্ডাদের। যজ্ঞ করতেন, যার শিখা উঠত অনেক উঁচু অবধি। দূর দূর থেকে লোক আসতেন তাঁর পুজো দেখতে। উনি বলতেন সেখানের মা নাকি খুবই জাগ্রত।
পাড়ারই এক ব্যক্তির পরামর্শে শিপ্রা পিসির বাবা-মা পিসির ব্যাপারে কথা বললেন হিমাদ্রী সাধুর সাথে। সব কথা শুনে উনি পিসির সাথে একবার দেখা করতে চাইলেন। দেরী না করে তৎক্ষনাৎ ওনাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। পিসির বাবা ওনাকে বলেন – টাকা-পয়সা যতই লাগুক উনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। কথাটা শুনে হাসেন হিমাদ্রী সাধু, বলেন, “টাকা-পয়সা দিয়ে কারুর প্রাণ কেনা যায় না রে... তবে, ওকে দেখে আমি জানলাম - ওর মধ্যে কিছু বিশেষ সুপ্ত গুণ রয়েছে, যেগুলো পর্বরতীকালে প্রকাশ পাবে। তাছাড়া তোদের মেয়ের মনের জোড় খুব বেশি, অন্য কোনো মেয়ে হলে এতদিনে মরেই যেত।”
শিপ্রা পিসিকে সাহায্য করতে রাজি হলেন হিমাদ্রী সাধু। ঠিক হল – আগামী অমাবস্যায় মন্দিরে কালী পুজ়ো সেরে তিনি আসবেন তাদের বাড়িতে। অনেক কঠিন কাজ করতে হবে। সারারাত ধরে চলবে কর্মসূচী। পিসির বাবাকে কিছু জিনিস আনিয়ে রাখতে বলে তিনি বেড়িয়ে যান বাড়ি থেকে।
যথারীতি অমাবস্যার রাত উপস্থিত হয়। মন্দিরের পুজো শেষ করে সোজা শিপ্রা পিসিদের বাড়িতে যান হিমাদ্রী সাধু। সমস্ত সরঞ্জাম নির্দেশ মত আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা ছিল। সিঁদুর, লেবু, খোসা ছাড়ানো নারকেল, প্রদীপ ইত্যাদি। হিমাদ্রী সাধু এসেই ফাঁকা ঘরের মধ্যে সিঁদুর দিয়ে একটা বড় ত্রিভূজ এঁকে ফেলেন, আর তার ভিতরে কোনো এক অজানা ভাষায় সিঁদুর দিয়েই কিছু লেখা লেখেন। তারপর ত্রিভূজের তিনটে কোণে তিনটে লেবু ও রক্তজবা ফুল রেখে দেন, এবং ভিতর দিক করে তিনটে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। তারপর পিঠের ঝোলা ব্যাগটা আস্তে আস্তে নামিয়ে ভিতর থেকে বের করেন তিনটে ছোটো ছোটো ঘট জাতীয় মাটির পাত্র, যার মুখগুলো ছিল লাল কাপড়ে মোড়া। সেগুলিকে তিনি ত্রিভূজের মাঝখানে রাখেন এবং তিনটে খোসা ছাড়ানো নারকেল চাপিয়ে দেন সে’গুলির কাপড় জড়ানো মুখের উপর। এরপর শিপ্রা পিসিকে নিয়ে আসতে বলেন পাশের ঘর থেকে। পিসি আসলে তাঁকে বসানো হয় ত্রিভূজের ভিতর, হিমাদ্রী সাধুর বামদিকে।
হিমাদ্রী সাধু পিসিকে বলেন, “কিছুক্ষণ পর তুই আর আমি ছাড়া এই জায়গায় আরেকজন আসবে। তুই তাকে একদম ভয় পাস না যেন। তোর কোনো ক্ষতি করবে না সে। সে আমার মেয়ের মত। তুই চোখ বন্ধ করে রাখবি, আর সে যা জিজ্ঞেস করবে তুই ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে উত্তর দিবি শুধুমাত্র। আর একদমই এই ত্রিভূজ ছেড়ে বাইরে পালিয়ে যাবি না। ঠিক আছে মা?”
“হুম্, ঠিক আছে।” –এটুকু বলতেই যেন খুব বেগ পেতে হল পিসির।
“তোরা বাইরে চলে যা। আর দরজাটাকে বাইরে থেকে টেনে দিয়ে যাবি। আমি যতক্ষণ না বলব এদিকে আসিস না যেন।” –শিপ্রা পিসির বাবা-মা কে বলেন হিমাদ্রী সাধু।
“মা রত্না, বেড়িয়ে আয় মা। দেখ... এই ছোট্ট মা-টার কি কষ্ট! তোর কাছে সাহায্য চাইছে মা রে। তুই আসবি না? রত্না মা আমার...” –একটা মাটির পাত্র থেকে নারকেলটা নামিয়ে রেখে, তার মুখের লাল কাপড় সরাতে সরাতে বলে চললেন হিমাদ্রী সাধু।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এক অপার্থিব গর্জনের মাধ্যমে শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল শিপ্রা পিসির। ঘরে আলোর পরিমাণ এতই বেড়ে গেছে যে বন্ধ চোখেও যেন চোখ ঝলসে যাবার উপক্রম!
“হু-উ-ম্-ম্!” –আবার সেই অপার্থিব গর্জন, সাথে কিছুটা গোঙানির আওয়াজ।
পিসি ঠক্-ঠক্ করে কেঁপেই চলেছেন ক্রমাগত। শীতের রাত্রেও ঘাম দেখা দিয়েছে তাঁর শরীরে।
“তোর নাম শিপ্রা?” –সেই বীভৎস গলায় নিজের নাম শুনে পিসির তো অবস্থা যেন আত্মারাম খাঁচাছাড়া।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে পিসি উত্তর দিলেন, “হুম্।”
“আভারাণী-কে চিনিস?”
“না।”
“প্রীতিকণা-কে?”
“হ্যাঁ। আমার সাথে পড়ে।”
কথা শেষ করার সাথে সাথেই শুরু হয় বিকট চীৎকার।
“শান্ত হ মা রত্না... শান্ত হ... বাচ্চা মেয়ে...” –হিমাদ্রী সাধু যেন কাকুতির সুরে বলে ওঠেন। “শুধু ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ –তে উত্তর দে শিপ্রা মা, আর কিছু নয়।” –তিনি পিসিকে কিছুটা শাসনের সুরে বলেন।
এতকিছুর মধ্যে হঠাৎই শিপ্রা পিসির মাথায় চলে আসে – আভারাণী তো তার সাহপাঠী প্রীতিকণার মায়ের নাম!
সাথে সাথেই পিসি অনুভব করেন তার কানের পাশ থেকে যেন একটা গরম হাওয়া ‘হুশ’ করে বেড়িয়ে গেল। সাথে সাথে পিছনের দরজাটাও যেন নিজে নিজেই সশব্দে খুলে গেল।
হিমাদ্রী সাধু চীৎকার করে শিপ্রা পিসির বাবা-মাকে ডাক দিলেন। ঘড়িতে তখন রাত আড়াইটে বাজে। পিসির বাবা-মা আসতেই উনি বলেন, “আমার কাজ এখানে শেষ। এ’বার আমায় বেরোতে হবে।”
পিসির বাবা-মা বাধা দিয়ে বলেন, “এত রাত হল, আপনি কোথায় যাবেন? আজ রাতটা আমাদের বাড়িতেই থেকে যান।”
“না না, এখানে থাকলে আমার চলবে না। চিন্তা করিস না, আমি আজ তোদের পাড়াতেই ওই পুকুর ধারটায় রাত কাটাব।” –হিমাদ্রী সাধু বলেন। “শিপ্রা মা, আজ রাত টা কোনো রকমে একটু কষ্ট করে কাটিয়ে দে। কাল সকালে উঠে দেখবি তুই পুরো ঠিক হয়ে গেছিস। আমি সকালে আসব তোদের বাড়িতে।” –পিসির দিকে ঘুরে তিনি বলেন।
পরের দিন সকালে, সত্যি সত্যিই পিসির সমস্ত কষ্ট যেন সম্পূর্ণরুপে উবে গেছে। অক্সিজেন সিলিন্ডারের আর কোনো প্রয়োজন নেই। খোলা হাওয়ায় তিনি স্বাভাবিক শ্বাস নিতে পারছেন। যেন কোনো ম্যাজিক হয়ে গেছে, অথবা কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন এই ক’টা দিন!
“তোর মেয়ে প্রতি ক্লাসে প্রথম হয়। আর ওর বন্ধু প্রীতিকণা কোনোবছরই সেই জায়গাটা পায় না। তাই ঈর্ষা তৈরী হয়েছিল তার মনে। তার মা আভারানী ওই পাড়ার রমেশ ওঝার সাহায্য নিয়ে বাণ মেরেছিল তোর মেয়েকে। যাতে আর সে পড়াশুনা না করতে পারে। আমার রত্না মা গিয়ে রমেশ ওঝাকে এমন শিক্ষা দিয়েছে না – সে আর এই জন্মে কোনো মানুষের ক্ষতি করার চিন্তা মাথাতেও আনবে না।” –হিমাদ্রী সাধু বললেন শিপ্রা পিসির বাবা-মা কে।
এরপর থেকে সবকিছু ঠিকঠাক চলতে থাকে। হিমাদ্রী সাধু মাঝে-মধ্যেই আসতেন শিপ্রা পিসির বাড়িতে, সকলের খোঁজ-খবর নিতে।
এতটা বলে চুপ করলেন বটুকবাবু।
“ব্যাস... শেষ?” –জগন্নাথ প্রশ্ন করল।
“পিসি বলতেন – তার বহু বছর পর এক রাতে স্বপ্নে একজন অচেনা মহিলাকে দেখেছিলেন। সেই মহিলা পিসির নাম ধরে ডেকে বলেছিলেন, ‘কেমন আছিস শিপ্রা? আমায় চিনতে পারছিস? আমি রত্না। আমার মুক্তি হয়ে গেছে আজ, আমি চললাম। ভালো থাকিস।’ পিসি স্বপ্নের মধ্যেই ঘাড় নাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘ভালো আছি।’ মহিলার মুখটা অচেনা হলেও গলার স্বরটা কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছিল পিসির কাছে। তার পরের দিন সকালে তাদের বাড়িতে খবর আসে – গত রাতে হিমাদ্রী সাধু বার্দ্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন।” –বটুকবাবু বললেন।
“আর হিমাদ্রী সাধু যে বলেছিলেন – আপনার পিসির মধ্যে কিছু বিশেষ গুণ আছে, সে’রকম কিছু কি ভবিষ্যতে প্রকাশ পেয়েছিল?” –জগন্নাথ প্রশ্ন করল।
“পরবর্তীকালে উনি প্রায় চারশো বাচ্চা নিয়ে একটা অনাথ আশ্রম চালাতেন। মানবতা ধর্মের গুণ থাকার চেয়ে বড় গুন আর কিসে হতে পারে?” –বটুকবাবু বললেন।
0 Comments