সুদীপ পাঠকের রম্যরচনা


গোলি মার ভেজেমে 
ভেজা গুল করতা হ্যায়... 

প্রসঙ্গ : আলুপোস্ত 

কালে হতেই শুরু হলো প্রলয় তুফান ঝঞ্ঝাবাত।ঘনঘোর ঘটার সঙ্গে কড়কড় কড়াৎ সাউন্ড এফেক্ট আর চোখ ঝলসানো বিদ্যুৎ রেখার স্পেশাল এফেক্ট। ভাবলাম হয়ে গেল!আজকের দিনটাও মাঠে মারা যাবে নির্ঘাৎ। মুহুর্তের মধ্যে শুরু হলো প্রবল বর্ষণ।ব্যাস আর কি,অবধারিত ভাবে আমাদের অঞ্চল জলমগ্ন হবে জানা কথা।কিন্তু কি অবাক কান্ড!খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বৃষ্টি থেমে গেলো,মেঘ কেটে গেল আর ঝলমলে রোদ উঠল।খুব সামান্য বৃষ্টিতেই আমাদের বিল্ডিং কম্পাউন্ডে জল জমে যায়।আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।তবে সুখের কথা কিছু পরিমাণ প্যাচপ্যাচে কাদার স্মৃতি রেখে সেই জল স্থায়ী রূপ নিলো না।যাক বাবা নিশ্চিন্দি ! এবার তাহলে বেরিয়ে পড়া যাক।মা আগেই একটা ছোটখাটো তালিকা ধরিয়ে রেখেছিল।যুদ্ধে যাবার মতন করে প্রস্তুতি নিয়ে পথে নামলাম।প্রথমে সটান হেঁটে হাজির হলাম দমদম সেন্ট মেরিজ স্কুলের মাঠে।লগ ডাউনের আগে পর্যন্ত দমদম রোডের উভয় পার্শ্বে চিত্রগুপ্তের খোলা খাতার মতন যে বাজার বসতো সেটি বর্তমানে স্থানান্তরিত হয়েছে ঐ জায়গায় । তবে শুধু মাত্র কাঁচা অনাজের পসরা বসে সেখানে।মাছ মাংস রাস্তাতেই বেচাকেনা চলছে।আজ গিয়ে দেখি অবস্থা বেসামাল। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক।এমনটাই আশা করেছিলাম।এই জমে থাকা জল কাদার মধ্যে ঘুরে ঘুরে মনের সাধ মিটিয়ে বাজার করা সম্ভব নয় তা বলাই বাহুল্য।চটপট পটল তুলে বেরিয়ে এলাম।সম্পর্ক যতই আদায় কাঁচকলায় হোক না কেনো একই থলের মধ্যে তারাও আছে।সঙ্গে তৃতীয়ার চাঁদের মতন একফালি অকাল কুস্মান্ড স্থান করে নিয়েছে।

ফিরে এলাম পাড়ায়।এক সঙ্গে এক পাল্লা (অর্থাৎ ৫ কে জি,বর্তমান প্রজন্মের সুবিধার্থে) নিলে দামে কিছু সুবিধা হয়। আজ ও তাই হলো তবে ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মতন করে।পরিচিতি আলু বিক্রেতা ছেলেটি প্রথমে গাইগুই করছিল। তার নাকি লাভ থাকছে না।আমি বললাম আমারই বা কি লাভ ? বাড়ীর নিচেই দোকান আছে।একটু যদি সুবিধা না পাই তবে এতো দূর থেকে বয়ে মরি কেনো ? ওষুধে ফল ফললো।বাকী কাজটা বিনা বাক্যব্যায়ে মিটে গেলো। 

সব শেষে মুদির দোকান।অপেক্ষাকৃত ছোট একটি দোকান থেকে খুচরো বস্তু গুলি সংগ্রহ করে থাকি।কারণ বড় দোকানে লম্বা লাইন।এখানেও দু'জন ক্রেতা রয়েছে । একজন অতি শীর্ণকায়া বৃদ্ধা যিনি সঙ্গে খাতা এনেছেন।নিত্যদিন যে সওদা হয় তার নগদানগদি লেনদেন হয় না।খাতায় লেখা থাকে,পরে পশ্চাতে থাবগো হিসেব মেটানো হয়।এই ব্যবস্থা এখানে বিশেষ জনপ্রিয়।ঐ বৃদ্ধা সেই দল ভুক্ত।আমি তার মুখ দর্শন করতে পারছি না কারণ শাড়ীর আঁচল দিয়ে শুধু ঘোমটা দেওয়া তাই নয় দক্ষিণ গোলার্ধও ঢাকা দেওয়া।উত্তর গোলার্ধে এক চিলতে উন্মুক্ত : চক্ষুদ্বয়।তাছাড়া দাঁড়িয়ে আছেন পাশ ফিরে সুতরাং তিনি যেনো অধরা মাধুরী। কিন্তু তাঁকে দেখার আমার এতো কৌতূহল কেনো সেটা এবার বলি। উনোকোটি চৌষট্টি অনেক জিনিস নিলেন। ফর্দ যেনো আর শেষ হতে চায় না।সব শেষ হলে ঝোলা থেকে বের করলেন একটি ঘিয়ের শিশি। প্রকৃত প্রস্তাবে প্লাস্টিকের ছোট্ট বোতল। তাঁর অভিযোগ আগের দিন তিনি যে পোস্ত নিয়ে গেছেন সেটি রান্নার পর বাড়ীর সবাই বলেছে কেমন যেন ল্যাদল্যাদে,মোটে ভালো না।সকলের অপছন্দ। বিক্রেতা গম্ভীর মুখে বলল

-মাসিমা এবার থেকে একটু বালি মিশিয়ে নিতে বলবেন।তাহলে দেখবেন কচকচ করবে । 

মাসিমা নাছোড়বান্দা।আগের পোস্ত ফিরিয়ে নিয়ে দাম এ্যাডজাষ্ট করতেই হবে।অসহায় দোকানদার বোতল চাপালো ইলেকট্রনিক ওজন মেশিনে।লাল সংখ্যা ফুটে উঠলো ২.৫৭ গ্রাম।এবার তার পালা!গর্জে উঠে সে বলল 

-আপনি কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছেন? এই তো খাতায় স্পষ্ট লেখা রয়েছে গত দিন আপনি ১০০ গ্রাম পোস্ত নিয়েছেন।এখানে রয়েছে আড়াইশো গ্রামের ওপর।তার মানে অন্য জায়গা থেকে কেনা জিনিস মেশানো আছে।তার দায় আমি নেবো কেনো ?  

মাসিমা টু শব্দটি উচ্চারণ না করে পত্রপাঠ বিদেয় হলেন। দ্বিতীয় যে ক্রেতা উপস্থিত ছিল এবার তার কথা বলি।অল্প বয়েসি ছেলেটি এতক্ষন উবু হয়ে বসে মন দিয়ে পচা পেঁয়াজের বস্তার মধ্যে থেকে খাবার উপযুক্ত যে গুলি তা বাছছিল।বটফলের থেকে সামান্য কিছুটা বড় আকৃতির এক কেজি পেঁয়াজ বেছে নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।সে এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল

-এই কারণেই হরিদা (বিক্রেতা) এখনো বিয়ে করেনি।এই সব পিকিউলিয়ার পাবলিক নিয়ে চলতে গেলে ব্যাচেলর না হয়ে উপায় নেই।

আমি প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করে ফিরতে পারলে বাঁচি ! উফ্ মাগো ! থলের ভিতর আলু আর মাথায় ঘুরছে পোস্ত।বাড়ী ফিরে ঘরে পা রেখেই মাকে বললাম 

-ঝালঝাল আলুপোস্ত আর বেশ ঘন করে বিউলির ডাল করো ।ওয়েদার চমৎকার, জম্পেশ করে খাওয়া যাবে ! 
জবাব পেতে এক মুহুর্ত সময় লাগলো না। 

-পোস্ত বাটবে কে শুনি? বিউলির ডাল তাই না? আদা হিং মৌরি বাটবে কে শুনি? আমার দ্বারা হবে না। 

বলা বাহুল্য আমার দ্বারাও হবে না।হলে করে নিতাম। আমাকে অধবদনে থাকতে দেখে মা পুনরায় যোগ করলো 

-ডিম আলু ভাতে দিয়ে দিচ্ছি আর পাঁচ অনাজের একটা ঝোল করে দিচ্ছি।তাই দিয়ে চুপচাপ ভাত খেয়ে নিবি ব্যাস্ ।  

চুপ করে আছি দেখে বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা মনঃপুত হচ্ছে না।তাই মাতৃদেবীর পুনঃসংযোজন 
কালকেই (আগামী) তো দশহারা,আবার সেই সঙ্গে গঙ্গাপুজো।এমনিতেই নিরামিষ খাবার দিন।রাতে লুচি হবেই।তোর পছন্দের কষা আলুরদম করে দেবখন,কেমন ? 

হরি ওম তৎসত !

ভাবতে লাগলাম আজ আলুপোস্ত ফস্কে গেলেও জলদি হবে বৈকি।পোস্ত এখন মহার্ঘ বস্তু!কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় এমনটা ছিলো না। 

যাই হোক আশার কথা এই যে রাজ্য সরকার পোস্ত প্রেমী বাঙালির কথা চিন্তা করে কেন্দ্র সরকারের কাছে পোস্ত (বাস্তবে গাঁজা) চাষের অনুমতি চেয়েছে।তবে ভাবনার বিষয় হল এই যে:সে সব অনেক দিন আগের কথা করোনাক্রান্তি ও আমফানের দাপট এতো দিনে সে সব আবেদন ও প্রতিশ্রুতি ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়নি তো ?

ধুত্তোর নিকুচি করেছে !যত সব উদ্ভট চিন্তা ভাবনা! কিসের সঙ্গে কিসের কানেকশন ? তার চাইতে বরং মনে মনে জিংগল গাওয়া যাক। 

সানডে হো ইয়া মন্ডে 
রোজ খাও আন্ডে।

অথবা ... 

আও শুনায়ু তুমহে আন্ডে কা ফান্ডা 
ইয়ে নেহি কোই মামুলি বান্দা।

অথবা একটা প্রিয় গান ...

মুরগি ক্যায়া জানে আন্ডে ক্যায়া হোগা? 
চিকেন বানেগা ইয়া তাওয়া মে ফ্রাই হোগা? 

সাহিত্যিক সুদীপ পাঠক
মধুগড়, দমদম, কলকাতা















0 Comments