সুপ্তা আঢ্য'র গল্প


ইতি আমি

"এই মিতা, তোর বর এসে গেছে রে..."

"যাক্ তোর অপেক্ষার দিন শেষ হোলো বল্ !"

"ধ্যাৎ,কি যে বলিস না তোরা?"

কনের সাজে সজ্জিতা লজ্জার লালিমায় লাল হয়ে ওঠা অনুমিতাকে দেখে হো হো করে হেসে উঠল বান্ধবীরা।

"একটা কথা জিজ্ঞেস করব রে?"

"বল্..."

"সৌগতদাকে কেমন দেখাচ্ছে রে?"

"একেবারে আমাদের রাজকন্যের জন্যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে আসা রাজপুত্তুর মনে হচ্ছে।কিন্তু---তুই কি এখনও দাদা বলেই ডাকবি?"

"না---মানে---জানি না---যা!" 

"যাক্,সবটা যে ঠিকঠাক হয়ে গেছে এটাতেই আমাদের আনন্দ। তোদের সম্পর্কের শুরুর থেকে আমরা সাক্ষী। "

ওদের কথা শেষ হতেই অনুমিতা বলে উঠল "আর কোনো গণ্ডগোল হবে না বল্!"

ওদের আলোচনা সুপ্রশস্ত হওয়ার আগেই বিয়ের মণ্ডপে ডাক পড়ল অনুমিতার। শুভদৃষ্টির সময় পানপাতা সরিয়ে লজ্জামাখা চোখে প্রেমময় চোখের বদলে সৌগতর নির্লিপ্ত চোখদুটো দেখে মনের আকাশে একখণ্ড কালো মেঘ বাসা বাঁধলেও তা সরিয়ে রেখে ওই চোখের মায়ার গহীনে ডুব দিল অনুমিতা।

"কি রে,চোখ সরাতে পারছিস না বুঝি? কিছুটা পরের জন্য রাখ।"

বন্ধুদের কথায় লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিল ও। শেষ রাতে লগ্ন থাকায় মালাবদল,সিঁদুরদান, সাত পাকে ঘোরা সবকিছু শেষ হতে নববধূর সিঁদুরে রাঙা সিঁথির মতোই টকটকে লাল প্রথম ঊষার আলোর আশীর্বাদ যেন নেমে এল পূবাকাশ থেকে। বিয়ে,বউভাত সবকিছু বেশ হইহই করে নির্বিঘ্নে মিটলেও সৌগতর মধ্যে কোনো ভাবান্তর চোখেই পড়ল না ওর।

নবপরিণীতা দুটি হৃদয়ের মিলনের রাত বড় আকাঙ্খিত---সেরকমই মিলন প্রত্যাশিত আকুতি নিয়ে লজ্জাবনত মুখে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল আমাদের নায়িকা। রাতের ভেলার সওয়ারী অন্ধকারের বোরখা পরা প্রভাকর রাত শেষের প্রথম প্রভাতের আলোয় সব কালিমা সরিয়ে নতুন দিনের আগমনী শোনালেও অনুমিতার মনের আঁধার ঘরে আলো জ্বালাতে ওর জীবন প্রভাকরের আগমনের অপেক্ষা---অপেক্ষাই রয়ে গেল।

"ভালোবাসার মানুষের আকণ্ঠ প্রেমের রস আস্বাদন করে পরিপূর্ণ নারী হয়ে ওঠা হলনা আমার" একথা ভাবতে ভাবতে ফুলসজ্জায় সাজানো ফুল শয্যার ফুলগুলো একপাশে সরিয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ল ও।

"কি গো, নতুন বৌ---বেলা তো অনেক হলো---এখনও ফুল শয্যার রেশ কাটে নি বুঝি?"

ধড়মড় করে উঠে সামনে শাশুড়িমা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত ভাবে বলল" না---মানে---একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এখুনি আসছি।" 

"দাঁড়াও---বাবু কোথায়?" 

"আমি জানিনা---সারা রাত জেগেই ছিলাম---ও আসেনি ।"

"হুঁ...শোনো বৌমা...বাবু যে তোমার কাছে কাল আসেনি একথা ঘুণাক্ষরেও কেউ যেন টের না পায়।" 

ওনার কথায় অবাক হলেও স্বাভাবিক ভাবে সারাদিন কাটালেও ওর চোখ সৌগতকে একমুহুর্তের জন্য আড়াল করেনি। যতবারই চোখে চোখ মিলেছে--- যে চোখের ভাষায় ও হারিয়ে গিয়েছিল একদিন,আতিপাতি করে খুঁজেও সেই ভাষার হদিশটুকুও পাচ্ছে না ও। 

বিয়ের বেশ কিছুদিন পর আত্মীয় স্বজন বিদায়ের পালা সাঙ্গ হলে বাড়ি মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেলেও সৌগতর সাথে একান্ত ব্যক্তিগত সময় যাপনের একটুও সুযোগ হয়নি ওর। এর মধ্যে ওদের বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য কানে আসছিল ওর। 

"কোথায় যাচ্ছ বৌমা?" 

"না---আসলে আপনার ছেলের সাথে কিছু কথা ছিল---তাই।" 

"সারাদিনের পরিশ্রমের পর ছেলেটা বিশ্রাম নিচ্ছে---এখন ওকে বিরক্ত কোরো না। নিজের ঘরে যাও।" 

"কিন্তু...মা..." 

"বললাম না ঘরে যাও...।" 

ওনার কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ নামিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসা বোবা কান্নাটা চেপে রেখে উদাস চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল নবোঢ়া অনুমিতা।সৌগতর সাথে কাটানো বসন্তের দিনগুলো আজকের এই রুক্ষ শীতার্ত দিনে বড্ড মনে পড়ছিল। নিষ্ঠুর উত্তুরে বাতাসের দাপটে কাঁপতে থাকা হৃদয় আজ ভালোবাসার উষ্ণতার পরশের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে জড়িয়ে থাকতে চায়। কিন্তু সৌগত...সে তো ফিরেও তাকায় না সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর দিকে। অবহেলার আঘাতে জর্জরিত করে দিচ্ছে ওকে।বিয়ের সময়টুকু ছাড়া একমুহুর্তের জন্যও স্বামীসঙ্গ না পাওয়া মেয়েটা আজ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। 

মধ্যরাতের মায়ায় সবাই যখন মায়াচ্ছন্ন, অনুমিতা শুধু একাকী জেগে মনের জ্বালায় নিদ্রাবিহীন রাত কাটানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। 

"কে...?" 

বেশ কিছুক্ষণ কোনো সাড়া না পেয়ে দরজা খুলে সামনে অনুমিতাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বলল"তুমি এখানে---এত রাতে?" 

"কোন কথা না বলে জোর করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল "কী হয়েছে সৌগত?"

"কী হবে? কিচ্ছু না ? কেন---কিছু হওয়ার কথা ছিল নাকি? "

"এভাবে কথা বলছ কেন?"

" কী বলতে এসেছ বলো!"

"আজ প্রায় এক মাস আমাদের বিয়ে হয়েছে---কিন্তু তুমি একটা দিনও আমার কাছে আস না। আমার সাথে এরকম কেন করছ তুমি?তোমার চোখের সেই উষ্ণতা কোথায় সৌগত? এত তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে গেল?"

"মুচলেখাতে শুধু মাত্র বিয়ের কথা ছিল---একসাথে থাকতে হবে এমন কথা বোধহয় ছিল না? তাই না অনু?"

সৌগতর কথায় শিউরে উঠে অনুমিতা বলল "কি বলতে চাইছ তুমি? "

"মেয়েদের সাথে ঘনিষ্ঠতা আমার একটা নেশা বলতে পার। তুমিও তার বাইরে কিছু না। নেশা কেটে গেলে তোমাকেও ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলাম ডাস্টবিনে। জোর করে প্রশাসনের সাহায্যে বিয়ে করতে বাধ্য করেছ বলেই তোমার সাথে একঘরে রাত কাটাব---ভাবলে কীকরে?যদি নিজেকে সামলাতে না পারো,তাহলে কলগার্লদের মতো রাস্তায় দাঁড়াতে পারো।"

"কী বলছ তুমি? নিজের স্ত্রীকে---রাস্তায় দাঁড়াতে বলছ? "

"স্ত্রী---মাই ফুট্! আশা করি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছ। এখন এসো এখান থেকে। রাস্তায় নামতে না পারলে অপেক্ষায় থেকো---টেস্ট বদলাতে মাঝে মধ্যে যাব--- আর সেদিন সবটুকু পুষিয়ে দেব মাই সুইটহার্ট।গুড নাইট। "

লজ্জায় অপমানে মাথা নীচু করে ধীর পায়ে সৌগতর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এক ধাক্কায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া ভবিষ্যতটাকে নিয়ে নিজের ঘরে এসে বসে রইল অনুমিতা। 

"লেখকের জবানীতে আমার অসমাপ্ত জীবনের এখানেই সমাপ্তি।"

চিঠিটা পড়ে হতভম্বের মতো বসে রইল সুচরিতা।হঠাৎ পেছনে পায়ের আওয়াজে তাড়াতাড়ি চিঠিটা লুকিয়ে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ভাবে বসে রইল ও। সব কাজ মিটিয়ে ঘরে এসে নবপরিণীতা স্ত্রীকে বাহুডোরের বাঁধনে বেঁধে আরও ঘনিষ্ঠ হতেই প্রশ্নটা এল "অনুমিতা কে? "

ভূত দেখার মতো চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল "মানে...? ক-কী বলছ---কিছু বুঝতে পারছি না।" 

"আমি কিন্তু সবটাই বুঝেছি।শোনো--- সকলের চোখে আমরা স্বামী স্ত্রী হলেও আজ থেকে আমাদের ঘর আলাদা।বাহ্যিক সম্পর্কটুকু ছাড়া আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না আমাদের।"

"এটা তুমি কি বলছ?" 

"এই একই প্রশ্ন অনুমিতারও ছিল।সেদিনের তোমার বলা উত্তরটা আজ তোমাকেই ফিরিয়ে দিলাম। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে...বেশী কথা ভালো লাগছে না। যাবার আগে লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে যেও।"

হতভম্ব সৌগতকে ঘরের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রেখে মাথা অব্দি চাদরটা টেনে হাতের মোড়া কাগজটা বুকে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল" তোমাকে আমি চিনি না। শুধু জানি...আমরা দুজনেই ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ আর সমাজের সর্বহেয় সৃষ্টি। আজ তোমার অপমানের কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিতে পেরেছি। যেখানেই থাক ভালো থেকো।"

লেখিকা সুপ্তা আঢ্য
তারাবাগ, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ 



 

















0 Comments