সৌমী আচার্য্য'র গল্প


খিদে

-হাড়হাভাতে মর,মর।আর কত খাবি?বাড়িতে আরো দুটো বোন আছে মা,বাপ আছে সে খেয়াল আছে রাবণ?

ভাত ভর্তি মুখে হ‍্যালহ‍্যাল করে হেসে ওঠে লাটাই।পুন্নি দুঘা পিঠে বসিয়ে দেয় তীব্র আক্রোশে।পনেরো বছরের লাটাই এক বোধহীন জীব।শুধু খাই খাই।গতকাল বাড়ি থেকে একপেট খেয়ে গিয়ে বামুন পাড়ার রতন ব‍্যানার্জ্জীর নোংরা ড্রেন পরিস্কার করছিলো।মেয়েদুটো এনে দেখাতেই পুন্নির ঝাঁট জ্বলে গেছে।

-শূয়োরের নাতি খেয়ে পেট ভরেনি দুটো শুকনো রুটি আর কুমড়োর বাসি তরকারীর লোভে ঐ পাঁক ঘাটছিস?

-জ‍্যেঠু বলেছে বোঁদেও দেবে।

আজ খেতে দিয়েই পুন্নি বলেছে,যত পারিস খা কিন্তু কারো বাড়ির নোংরা ঘাটবি না গরীব বলে মান ইজ্জ্ত থাকতে নেই?

-মান,ইদজত কি মা?

-চুপ কর খা যত পারিস।

-ছব খাবো?

-হ‍্যাঁ গেল গেল।মরলে হাড় জুড়ায় আমার।সারাদিন শুধু খাই খাই।খা কত পারিস খেতে আমিও দেখি।

হায়রে কেন বলেছিলো একথা।কলমি শাক দিয়ে প্রায় আড়াই কৌটো চালের ভাত খেয়ে নিলো ছেলেটা।সারাদিন মেয়েগুলোকে দেবে কি?শ্রীদাম মুড়িভাজা কল থেকে ফিরবে সেই সাতটায় তার আগে তিনটে পেটের উপবাস।দিশেহারা হয়ে যায় পুন্নি।শ্রীদাম বড়ো রগচটা লোক।এমনিতেই ছেলেটাকে সহ‍্য করতে পারেনা তার উপর আজকের কথা শুনলে আস্ত রাখবে না আর।সূর্য গলতে থাকে ধীরে ধীরে।ভয়টা ছড়িয়ে যায় মনের গভীরে।এদিকে এক হাঁড়ি ভাত আর মার খেয়ে নির্বিকার লাটাই নদীর ধারে ধারে ফড়িং ধরে বেড়ায়।সন্ধ‍্যে হতেই খিদে চাগান দিলে বাড়ির মুখে গিয়ে দেখে বাবা মাকে মেরে পাটপাট করে দিচ্ছে মুখে অশ্রাব‍্য গালি।বুঝতে পারে সব ভাত খেয়ে নেবার ফল।কি করবে ওর যে বড্ডো খিদে পায়।সব খেয়ে নিতে ইচ্ছে করে।মাকে যখন বাবা লাল চোখ করে পেটায় তখন একঢোকে বাবাকেও খেয়ে নিতে ইচ্ছা করে কিন্তু অসুরের মতো লোকটা আছড়ে ফেলে মাটিতে বারবার।খুব লাগে গায়ে মাথায়।তাড়াতাড়ি থপথপ করে বাড়ির থেকে দূরে সরে যায়।হাইরোড ঘেঁষে ধাবার দিকে পা বাড়ায়।গন্ধটা বড্ড টানে।খুব লোভ হয় লাটাইয়ের।হাতটা বাড়িয়ে দেয়।

অনেক রাতেও ছেলে ঘরে না আসায় পুন্নি রাস্তায় রাস্তায় ডাকে,লাটাই ও লাটাই।সারা পাড়ায় খুঁজে পায়না।আরেকটু এগিয়ে হাইরোডে ওঠার মোড়টার কাছাকাছি যেতেই খুব চ‍্যাঁচামেচির শব্দ পায় একই সাথে কারো পরিত্রাহি চিৎকার।পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে যায় পুন্নি।ভিড় সরে গেলে প্রায় উলঙ্গ রক্তাক্ত শরীরটা কেউ একজন উল্টে দিতেই আৎকে ওঠে,আহা গো কার ছেলে এমন মার খেলো?পুলিশ এসে মাটিতে ঝুলে পড়া চোরের শরীর তুলে নেয়।কাঁদতে কাঁদতে পুন্নি ডাকে,ও লাটাই,লাটাইরে।অবসন্ন হয়ে বাড়ি ঢুকতেই দেখে কলের পাড়ে থেবড়ে বসে আছে ছেলেটা।দৌড়ে যায় পুন্নি,এতক্ষণ কোথায় ছিলি?চল খাবি চল।

-আমায় খেতে দিয়েছে তককা আর রুটি দুটো লরিআলা।বলেছে কাল আবার দেবে যদি যাই কিন্তু রক্ত পড়ছে আর ব‍্যথা করছেরে মা।শরীর যেনো পাতর।

-ও মাগো,একি সর্বনাশ।কে করলো এমন?ও লাটাইয়ের বাবা এই দেখ কি রক্ত বেরুচ্ছে।

ছিন্নভিন্ন রেকটামের যন্ত্রণায় রক্তে ভাসতে ভাসতে হাসপাতালের নড়বড়ে বেডটা শক্ত করে ধরে লাটাই।মার দিকে তাকিয়ে ক‍্যাবলা হেসে বলে,কাল ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত খাবো মা।এই পখোটে একশো টাকা দিয়েছে ওরা।তুই নিয়ে যা।কাল ডিমের ঝোল আনবি ঝাল করে আর অনেকটা ভাত।আনবি তো?

সকাল সকাল হাসপাতালে যাবার জন‍্য তৈরী হয়ে নেয় পুন্নি।টিফিনবক্সে ডিমের ঝোল আর ভাত নিয়ে ছুটতে থাকে।ঐ হাড় হাভাতের মুখে নিজে হাতে গরাস তুলে দেবার জন‍্য ছটফট করতে থাকে কিন্তু লাটাই তখন সব খিদে ছাড়িয়ে চলেছে অনেক দূরে।

-লাটাই,লাটাইরেএএএএ,দুগেরাস ডিমের ঝোল ভাত খেয়ে যা বাপ আমার।

লেখিকা সৌমী আচার্য্য
বি-১৩/১১০,কল‍্যানী, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ 




0 Comments