স্বভাব কবি ~ শ্রীপর্ণা দে'র অণুগল্প


শ্রীপর্ণা দে'র অণুগল্প
স্বভাব কবি

বোলপুরের সদাশিব ঘোষকে চেনে না এমন মুষ্টিমেয় লোক কমই পাওয়া যাবে। সাধারণ কথা বলতেও ছড়া অথবা কবিতার আশ্রয় নেন বলে পাড়ায় তাঁর পরিচয় স্বভাব কবির। কারণে- অকারণে কবিত্ব করতে তিনি ওস্তাদ। তাঁর ঠোঁটের ডগায় কবিতা লেগেই আছে।কবি সদাশিব বিবাহিত জীবনের সমস্ত দায়দায়িত্ব স্ত্রী নীলিমার কাঁধে চাপিয়ে নিশ্চিন্দে আছেন। তাঁর বউটিও হয়েছে লক্ষ্মীমন্তর।সদাশিবের মতে সংসারের ঘোরপ্যাঁচ নাকি শিল্পী মানুষের পক্ষে বোঝা দুরূহ। তাই ওসবের মধ্যে অনুপ্রবেশ তাঁর পছন্দ নয়। অনেকেই নীলিমাকে অভিযোগ করে স্বামীর ঔদাসীন্য নিয়ে। রোজগারহীন পুরুষ মানুষের জীবন যেরকম বাউন্ডুলে হয় সদাশিবের জীবন খানিকটা সেরকম। সম্পূর্ণ বাউন্ডুলে না হওয়ার কারণ তাঁর মৃত বাবা আর্মি অফিসার সদানন্দবাবুর আর্থিক সঞ্চয়। তাঁর মন্থর দিনযাপনে সংসার এবং স্ত্রী নীলিমার কথা ভাবার অবকাশ নেই। দশ বছরের ছেলে টিটুর প্রতিও তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি চলেন নিজের খেয়ালে।

নীলিমার প্রতিবেশী বন্ধু জয়া ভাবল যে সুযোগ পেলে কবি সদাশিবের কবিত্ব দূর করবে। গুরুতর অভিযোগে কবিত্ব যে তাঁর কি করে আসে তাই সে দেখবে। জয়ার সাত বছরের মেয়ে মাম্পির খেলার সাথী টিটু। খেলতে খেলতে হঠাৎ হঠাৎ মারপিঠ ঝগড়া দুটিতে লেগেই আছে। মারপিঠ করার ফলস্বরূপ দুজনের মধ্যে কারোর হাতে পায়ে ব্যথা,কারোর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অল্পস্বল্প ক্ষত এসব সাধারণ ব্যাপার ঘটেই থাকে। একদিন জয়ার সুযোগ এলো সদাশিবের কবিত্ব পরীক্ষা করার।

গতকাল কোনো এক অজ্ঞাত কারণে টিটু এবং মাম্পির মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়। টিটু স্কুল থেকে ফিরে আসার সময় রাস্তায় মাম্পিকে দেখে তার কানে আলপিন ফুটিয়ে দিয়ে বলল-‘এই তোর কান ফুঁটো করে দিলাম।’ মাম্পি যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে বলল-‘বাঁদর ছেলে একটা। তোর বাবা- মাকে বলছি দাঁড়া।’ মাম্পির কান্না দেখে জয়া সদাশিবের কাছে গিয়ে কড়া গলায় বলল- ‘সংসারের তো কোনো খবর রাখো না। ছেলেটারও কোনো খবর রাখো না। কি করে সে, কোথায় যায় এসব খবর তোমার কাছে আছে! আজ তোমার ছেলে আমার মেয়ের কানে পিন ফুটিয়ে কান ফুঁটো করে দিয়েছে। মেয়ের কানে প্রচণ্ড ব্যথা লেগেছে। এর বিচার করতে হবে তোমাকে। আমার কথা এড়িয়ে গেলে হবে না।’ জয়ার গলা পেয়ে নীলিমা ঘর থেকে ব্যস্ত হয়ে কি ঘটেছে জানতে বাইরে বেরিয়ে এলো। জয়ার অভিযোগ শুনে সদাশিব লোকসঙ্গীত গায়কদের মতো সুরে সহাস্যে কাব্যি করে বললেন-
কানে ফুঁটল আলপিন,কান করে চিনচিন
আমাকে নালিশ করে আর কি হবে লাভ !
আজ যারা শ্রেণীশত্রু কাল তাদেরই হবে ভাব।

সদাশিবের অঙ্গভঙ্গি দেখে জয়া হেসে বলল- ‘তোমাকে নিয়ে দাদা পারা যাবে না। তুমি কি কোনোকিছুই গুরুত্ব দিয়ে ভাববে না। সংসার সমাজ রসাতলে যাক তাতে তোমার কিছু যায় আসে না। নীলিমা বলেই তোমার মতো একজনের সঙ্গে ঘর করে। ধন্য তোমার কাব্যি বাপু। আমি চললাম।’ নীলিমার দিকে তাকিয়ে সদাশিব নিষ্পাপ শিশুর মতো হেসে উঠলেন।    

 

সাহিত্যিক শ্রীপর্ণা দে 
কান্দি, কলাবাগান, মুর্শিদাবাদ

   

                            
                                      




 



0 Comments