ফিরে ফিরে আসা ~ অন্তরা দাঁ এর মুক্তগদ্য


অন্তরা দাঁ এর মুক্তগদ্য

ফিরে ফিরে আসা

সব আসা আর যাওয়া শুধু ফিরে ফিরে বারবার দুয়ারে দাঁড়ায় ! তবু চৌকাঠ পেরোতে পারে কই? ফিরে যে আসে, সে, যে ফিরে গেছে সে নয়। অন্য একজন, তার দুঃখকাতরতা নিয়ে গভীর অভিনিবেশে এসে দাঁড়ায় শূন্য আঙিনায় অথবা রিক্ত হাতে যে নেড়েছিলো বিদায়ের আঙুল সে একদিন অতুল ঈশ্বর্য করতলে সোনামুঠি করে, তুচ্ছ করে ফিরে যাওয়ার গূঢ় বেদনার মুহূর্ত, তখন আর হাজার অনুরোধেও সে ফিরে তাকায় না ফেলে আসা পথের দিকে।  এই দোলাচলই তো জীবন,বহমানতা, গন্তব্য বদলে বদলে যায়।
ফেরা হয়না নিজের কাছেও। যে আমি ফিরতে চেয়েছিল সে হয়তো বদলে যায় অথবা ফিরতে চাইলেও সে আর কোনোদিন রাস্তা খুঁজে পায় না, ঘুরে মরে অবাক ভুলভুলাইয়ার সুড়ঙ্গে!

মুকুলিত বালিকাবয়েস কথা দিয়েছিল ফিরে আসবে, আসেনি। চলে গেছে সে তার আলতা-রাঙা নূপুরের ছমছম সুর তুলে কোন দূরে পাড়াগাঁর মেঠোপথে বেতসলতায় জড়িয়ে-মড়িয়ে। কিম্বা শহরের পিচগলা দুপুরের তেষ্টায়, ইস্কুল কেটে সিনেমাহলের অন্ধকার ফিসফিসে, ইউনিফর্ম লুকোনোর অমোঘ চেষ্টায়, চটপটি আর আলুকাবলির অবাধ স্বেচ্ছাচারে, কুলের আচারের প্রতুলতায়, ফুচকার টকজলের নিষিদ্ধ হাতছানিতে, হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়ার অননুভূত স্পর্শে!
শৈশবের কচি তালশাঁসের মত নির্মল সময়ে লাগে কৈশোরের জারুল ফুলের পাপড়ির মত ফিনফিনে ইচ্ছের বাতাস, শিরশিরিয়ে ওঠে শরীর, সেই নিঃস্তব্ধ ডাহুক ডাকা দুপুর, ইস্কুলবাড়ির ছুটির ঘন্টা, কাঁচা আম-ছেঁচার অম্ল-মধুর আস্বাদ, সাদা-কালো ছায়াছবির মত, সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালি' র মত, বন্ধক রাখা যায় নষ্ট্যালজিয়ার কাছে কিন্তু ফেরানো যায় না। শুধু মেঘ করে আসে মনখারাপের সন্ধেয়, যখন বাড়ি খালি করে সবাই অনুষ্ঠানে গেছে, বা কোন জলসায়, লোডশেডিং চলছে, বিদ্যুৎচমকের আলোয় উদ্ভাসিত চেনা পথঘাটের অচেনা গন্ধ, তখন পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসে অতুলপ্রসাদ, তখন হঠাৎই ভীষণ মনকেমন করে, অতীত উঠে এসে পাশটিতে বসে। তখন আর কেউ থাকে না, ছোট্টবেলার সেই হ্যারিকেনের আলোর রূপকথা ছাড়া!

প্রথম প্রেম বলেছিল ফিসফিসিয়ে যে করেই হোক ঠিক ফিরে আসবে, আসেনি। এক ঝড়ের রাতে বাতাসে কুটি কুটি করে উড়িয়ে দিতে হয়েছিলো সব প্রেমের কবিতা, ডায়েরির পাতায় লেখা ইচ্ছেপত্র, গোলাপের শুকনো পাপড়ি আর হৃদয়ভাঙার টুকরো-টাকরা। ঝড়ের শেষে ভোরের ক্ষমাসুন্দর আলোয় স্মিত হাসিতে যে আমায় দু'হাতে জড়িয়ে নিয়েছে বুকে, তার নাম বিরহ। সে প্রেমেরই নামান্তর তবু প্রেম নয়। ফিরে আসেনি সে প্রেম, যাকে আমি গোপন স্পর্শকাতরতার মত লালন করেছি হৃদয়ে যেন অসাবধানে সরে যাওয়া লিঙ্গত্বক, মায়ের বিভাজিকায় ঘামের গন্ধের মত পবিত্র! আমার করতল শুধু হাতড়ে হাতড়ে গেছে কারোর হাত। পুরনো কলঘরে শ্যাওলার মত বিপদসংকুল চাহিদাদের পাশ কাটিয়ে যখন ভেবেছি নিজেকে নিরাপদ, আবছায়া হয়ে এসেছে সাধ, প্রবল বিদ্রুপে তছনছ হতে হতে ভেবেছি — প্রেম মানে সর্বনাশ!

ফিরে আসেনি অমল আনন্দ কিম্বা গভীর দুঃখবোধ। কল্পনার এক দিগন্তঘেঁষা মাঠ ছিলো আমাদের, গোল্লাছুটের ঘর কাটা, সবুজ মেখে গোল গোল করে উড়তো সস্তা ছিটের ফ্রক, চোরকাঁটা বিঁধে থাকতো ইচ্ছেডানার নরম মজ্জায়। চার আনার কটকটে চিনির মাছ লজেন্সের স্বর্গীয় মিষ্টি স্বাদ জিভে তখনও লেগে থাকতো। পুজোর চারটিদিনের জন্য বরাদ্দ একখানিই নতুন জামার খইয়ের মাড়ের গন্ধ স্মৃতির আকাশে মাঝেমধ্যেই উড়াল দেয় পরিযায়ী সাইবেরিয়ান হাঁসের মত, তাদের পাখসাট থেকে ঝরে পড়া মুহুর্তেরা মৃত তারাদের মত নিনির্মেষে চেয়ে থাকে বিস্মৃতির ধুলো মেখে। সেই আনন্দ কখন বদলে গেছে গভীর বিষাদে। একে একে খ'সে গেছে প্রিয় মুখ, অতল চোখের আশ্রয়। আবেগের রাধানাম লিখেছি যে বুকের ভেতর তারই মালা জপি নিশিদিন, কন্ঠীবদল হলো, সপ্তপদী গমনের পথে হারিয়ে গেলো চোখের তারায় ধরা মানুষের হাসিটুকু, বাসরশয্যায় সে তখন একা! সাজঘর তাকে নববধূ করেছে অথচ বুকের গভীরে ঢেলেছে ময়ূরকন্ঠী জেলির মত তীব্র বিষ, পোড়া ধূপের ছাইয়ে লেখা হয়ে গেছে তখন অনাগত ভবিষ্যতের পান্ডুলিপি। অমল আনন্দ কখন বদলে গেছে সস্তা সুখে, সে সুখের চাবিকাঠি বাঁধা আছে বহুতল ফ্ল্যাটের ঝাঁ চকচকে মেঝেয়, শালীন পর্দার ঘেরোটোপে,পাঁচতারা হোটেল-রেঁস্তোরার কন্টিনেন্টাল ডিশের ফ্লেভারে, এনিভারসারিতে পাওয়া ডায়মণ্ড রিংএর উজ্জ্বলতায় কিম্বা একটা হলিডে ট্রিপের গায়ে যে আলস্য লেগে থাকে ঠিক সেরকমটি। এক হলুদ-বসন্ত পাখির পালকের মত মসৃণ নরম ফাগুনের মাসে আমার ঠাকুর্দা তার পৈতৃক ভিটের একখানা ছোট আলোবাতাসহীন ঘরে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেলো। কী শান্ত শীতল নিঃশব্দ পদচারণা মৃত্যুর অথচ নির্মম সেই পরিণতি বোঝার আগে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো ছ'ফুট, ফরসা ধবধবে,সারাক্ষণ সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী পরা আমার ঠাকুর্দা। শুধু দুঃখ নয়,এক গভীর বিষাদ আমায় ছেয়ে রেখেছিল দীর্ঘ সময়। আজ, জীবনের উপান্তে এসে দেখি আনন্দ আর বিষাদ একটাই কয়েনের দুটি দিক। জড়ামড়ি করে থাকে, তবু তারা যেন দুটি সতীন, একে অপরকে ভেঙিয়ে চলে প্রত্যহ।

ফিরে আসে না কিছু, তবু আজকাল ঘুম না এলে শেষ রাতে বারান্দায় এসে বসি, পশ্চিম আকাশে তখনও তারারা বাসরশেষের কাজল মুছে টুপ করে স্নান করতে নামবে যেন সাগরতীরে। পূব আকাশ ফুটি ফুটি করছে আলোর ইশারায়। কে যেন এসে বসে পাশটিতে, তার মুখ আমি কোনোদিন দেখতে পাইনা, সে এসে যেন তার হিমশীতল আঙুল আমার রাতজাগা চোখে বুলিয়ে বলে
— কষ্ট? খুব কষ্ট তোমার?
আমি ব্যগ্র হয়ে বলি
— ভারী কষ্ট আমার জানো...
কত কী যে বলে যাই, সে আমার নিজেরও মনে থাকে না।
সে আমায় বলে
— ফিরে চলো...
আরও একটা দিন ফিরে আসে, প্রায় আগের দিনটির মত, তবু আগের দিন সে তো নয়। আমার ফেরা হয় না...
তবু জানি একদিন আমি ফিরব, সে আমি এই আমি নয়, আলো কমে আসছে, কুঁচকে আসছে ত্বক, যৌবন ছেড়ে যাচ্ছে, শরীরের ভেতর থেকে উদগ্র হচ্ছে উপবাসের গন্ধ...
যে ফিরবে সে আমি নয়।

গদ্যকার অন্তরা দাঁ
কাঁটাপুকুর উত্তর, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ







2 Comments