পথ
গভীরে কোথাও এক জন্মদাগ। নক্ষত্রের নাভিকুন্ড পুড়ছে অল্প শীতে। আমাদের খাদ্যের উত্তাপ থেকে সরে যাচ্ছে একটা জন্ম, অলখ এক তরঙ্গের দাগ। বেশী পুড়ে যাওয়া মাটির মন্দিরে প্রণাম লেখা এক অন্ধকারে দুলছে দুধলতা। তার ঠোঁট, নাভি ও মৃত্যুর সব আয়োজন মুছে গেছে। অসুখজ্যামিতির ঈশ্বরের ক্ষীণ চিৎকার দূরে কোথাও ফেলে এসেছে সন্তানপ্রভ এক আলো।
ধুলোপায়ের ইতিকথা শুনতে শুনতে এক আলোছায়াপথ আনমনা হয়ে গেছে আমাদের চিবুকে, আলজিভে, বৃন্তে, স্বাধিষ্ঠানে। দেখা হবে না কোথাও। একটি স্ফুলিঙ্গের অবসর থেকে কঠিনতম মাংসে আমি ছদ্মবেশ লিখি। তোমার অপরিচয় ঘষি অগণন মৃগশিরা মাখা শস্যক্ষেত্রে। এই ছিন্ন আয়োজনে আমি গ্রাস করি তোমার দ্বিখন্ডিত বিষ।
বিষ সরিয়ে নিয়েছে মৃগব্যাধ। দুধপিঠের দাগ থেকে সন্তানসমৃদ্ধ আলো তুলে আমি তোমাকে পথ দেখাই। দৃশ্যত মেঘলা অন্তরাকাশ আস্তে আস্তে আর্দ্র করে তোলে হাওয়ার নির্দেশিকাগুলি। জিজ্ঞাসায় ক্লান্ত হয়ে উঠছে পায়ের আঙুল।
আলো
উজ্জ্বল লাল এক পাখির শরীর আমাদের ভিতরে প্রশ্ন রেখে চলেছে। তার নখ এসে জুড়ে যাচ্ছে অন্ধ বিনোদবিহারীর আঙুলে। খোয়াইয়ের নরম জলে আমরা হাঁটছি। এই অকালরক্তের ভৈরবীর নাম দেবগর্ভা, ভৈরবের নাম রুরু। ঈশ্বরের অবশিষ্ট প্রসববেদনাকে আমরা লুকিয়ে নিয়ে আসি ঘুমন্ত জনপদে।
এক তরঙ্গমুখ তৈরি হয় আমাদের স্মৃতিতে। তাকে দিয়ে আমরা বলিয়ে নিই সংলাপ। শূন্যতার ভিতর জল পড়ে। জলের স্থিরত্বের ওপর দিয়ে উড়ে যায় শাদা বক। ঈশ্বরীর কঙ্কালের সামনে দাঁড়িয়ে আমি চিবোতে থাকি তোমার যন্ত্রণা।
ফিরে তাকানো একটা পথ ভুল করে। দৃশ্য থেকে ধাক্কা মেরে তোমাকে সরিয়ে দেয় অন্ধ ঈশ্বরের ভ্রুমধ্যে। সেখানে ফুটে উঠছে ঘাম। প্রাচীনতম আলো নিভছে, আবার জ্বলছে। জ্বলছে এক উর্ণনাভ দোষ দেখাবে বলে। সে তন্তুতে ধীরে ধীরে শিশির জমা হয়।
ছায়া
স্বপ্নকে দিয়ে আরো কিছুটা বলিয়ে নিই আমরা। সোনালী রঙ গোলার পর দু’জোড়া পায়ের ছাপ এগিয়ে আসে আমাদের স্মৃতিহীনতায়। আমরা ছুটতে থাকি। আটপৌরে রক্তের দাগের পাশ দিয়ে, মৃগব্যাধ নক্ষত্রমন্ডলীর শীতের ভেতর দিয়ে আমাদের খিদেটাকে কামড়ে ধরে সেই ছাপ। প্রসবরসের দাগ থেকে শেষ আলো গড়িয়ে পড়ে এক ধানদুখী বিকেলে।
রঙের মৃত্যু থেকে আমাদের ফিরিয়ে আনে শিল্পীর ধূসর আঙুল। কেঁপে ওঠা জলের ভাষার ওপর দিয়ে আমরা বাঁচিয়ে ফেলি বুদবুদের অস্থিরতা। ভোরের স্বপ্নের বৃদ্ধিগন্ধ বেয়ে ধানের শিষে দুধ আসে। পরীক্ষায় ধরা পড়ে সুখ। আয়ুরেখার আনন্দ-ঘুম থেকে ভেসে ওঠে সন্তানপ্রভ আলো।
একটি সংকেত, একটি আলো, একটি অন্ধকার- একই পাত্রে দুঃখের বিশুদ্ধতা মেপে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছে অস্ফুট স্মৃতিহীনতায়। সময় থেমে গিয়েছে। কিম্বা অপেক্ষা করছে, কখন জলের পাতলা সর ভেঙে ভেসে উঠবে একটি সাপের মাথা। সেই সাপ রক্তের অধিকার চেটে ফিরে যাবে অদৃশ্যে।
ধূলি
শুধু পাখির আঙুল ঘন হয়েছে আমাদের প্রতিবিম্বে। আর দূরে পড়ে রয়েছে শব্দের হৃদয়, অদূরে শব্দের ঠোঁট। এখানে তির্যকভাবে সতীদেহ পড়েছে এই মহাকালের দুর্বলতায়। তৃষ্ণাশূন্য কৃষ্ণসারের দল পার হয়ে যায় এক যজ্ঞীয় দেশ, ছায়া, রক্তবর্ণ কুয়াশা। তাদের ফেলে যাওয়া আংশিক মৃত্যু ও দুধ ভিজিয়ে দেয় আমাদের অন্ধত্ব, ভিক্ষান্নের ভিতর লুকিয়ে রাখা পাপ। আমরা ছুটতে পারি না।
অন্ধঘুমের ভেতর নিষ্পলক দাঁড়িয়ে থাকে কৃষ্ণসারের কঙ্কাল। ধুলো ওড়ে। একটি শব্দের মৃত্যু টোকা মারে আমাদের দূরত্বে। স্বাধিষ্ঠান চক্রের কমলা অন্ধকার থেকে স্পর্শাতীত পিপীলিকার সারি ঢুকে যায় তীব্র আলোয়। অসময়ে প্রেমের ছবি দেখতে বসি আমরা।
সে ছবি আটকে যায় আমাদের লালারসে। আর ছবি ফেটে বেরিয়ে আসে আদিম অন্তঃসত্ত্বা নারী। আমাদের কাছে খাবার চায়। আমাদের তলপেট থেকে অনেক বেশী আলো সরিয়ে নেন ঈশ্বর। ঈশ্বরের অন্ননালীতে আমরা আঘাত করি।
কবি তন্ময় ধর
আলমোড়া, উত্তরাখণ্ড, ভারত
0 Comments