ঋভু চট্টোপাধ্যায়ের গল্প


ফুল প্যান্ট                  

লাস্ট বেঞ্চে বসলেও ইতিহাসের অমলেন্দু স্যারের চোখ এড়াল না।পড়াতে পড়াতে স্যার সারাটা ক্লাস ঘুরে বেড়ান।লাস্ট বেঞ্চে অম্বরের কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পড়ালেন।ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে বোঝাতে বোঝাতে আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।চোখ দুটো আটকে গেল অম্বরের প্যান্টে।দুবার ভ্রু’জোড়া ওপরের দিকে তুলে বললেন,‘কি বাবু, স্কুল ড্রেস কোথায়?’ অম্বর উঠে স্ট্যাচুর মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।জানে স্যার মারবেন না, কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে বকবেন।গা জ্বালা করা অপমান সূচক কথা বলবেন।তার মানে ক্লাসটা গেল।অম্বরকে নিয়েই পড়ে থাকবেন, বাকি কাউকে পড়াও ধরবেন না।এই পিরিয়ডটা একই বিষয় নিয়েই চর্চা করবেন আর ক্লাসের বাকি ছাত্ররা সবাই হো হো করে হাসবে। টিফিনে অন্য ছেলে মেয়েরা এসে জ্ঞান দেবে।শেষকালে অম্বরকে চোখ মুখ লাল করে বাড়ি ফিরতে হবে, যন্ত্রণার শেষ থাকবে না।অম্বরের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে স্যার আবার জিজ্ঞেস করলেন,‘কি বাবা, কোন উত্তর নেই যে, শুধু ভালো পড়া করলেই হবে।স্কুলের ডিসিপ্লিনটাও তো মাথায় রাখতে হবে।তা না করে তুমি একটা অন্য কালারের ফুল প্যান্ট পরে চলে আসবে?’
কানদুটো গরম হয়ে যাচ্ছিল।ক্লাসের সেকেণ্ডবয়, শেষ বার্ষিক পরীক্ষাতেও ফাস্টবয়ের থেকে অঙ্ক, ইংরাজি, আর দুটো বিজ্ঞানে নম্বর বেশি পেয়েছিল।শুধু ইতিহাস, ভূগোলেই নম্বর কমে যাওয়ার জন্য টোটালটা কিছুটা কমে যায়।লাইফ সায়েন্সের ইদবক্স স্যার, অঙ্কের প্রীতিকণা মিস, ফিজিক্যাল সায়েন্সের বরুণ স্যার অম্বরকে সব সময় ফাস্ট বেঞ্চে বসান।ক্লাসের অন্য কেউ কোন অঙ্ক না পারলে মিস আগে অম্বরকে অঙ্কটা করতে দেন, অম্বর না পারলে নিজে করেন।এই নিয়ে ফাস্ট বয়ের রাগও কম নয়।কথায় কথায় শোনায়,‘তুই তো হাফ মাস্টার হয়ে গেছিস।’
কিন্তু অমলেন্দুস্যারকে তো সেই সব কথা বললে চলবে না।ভয় ভয় মুখ করে মাথা নিচু করেই উত্তর দেয়,‘স্কুলের ফুল প্যান্টটা কেনা হয় নি।বাবা বলেছে দু’মাস পরে কিনে দেবে।’
-দু’মাস!ভালো ভালো, খুব ভালো।
তারপরেই স্যার অম্বরের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খ্যাক ক্যাক করে হেসে উঠলেন।খুব বিরক্ত লাগল অম্বরের।মনে হল কানের কাছে কেউ যেন টিনকাটা বাজাতে আরম্ভ করেছে।খ্যাক খ্যাক,ট্যাক,ট্যাক্।হাসি থামিয়ে স্যার বললেন, ‘হাফ প্যান্ট নেই ?’
-আছে স্যার।
-তবে তো ঠিক আছে। হাফ প্যান্ট পরে আসবে।নাকি মেয়েদের কাছে পা দেখাতে লজ্জা করবে,স্ট্যাইল মারা যাবে না?
 অম্বর উত্তর দিল না।স্যার আরো কিছু সময় অম্বরের দিকে তাকিয়ে বললেন,‘বুঝলে?’
-খুব ঠাণ্ডা স্যার।
-হোক! 
পুরো ক্লাসটা চমকে উঠল।স্যার আবার বলে উঠলেন,‘শোনো,যদি ড্রেশ পরে আসতে পারো ভালো, না হলে দুমাস পরেই আমার ক্লাসে বোসো।এখন বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।’
অম্বর সব কথা শুনেও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল।স্যারের কথাগুলোতে মাথার ভিতরটা ঝনঝন করছে।কি করা যাবে?স্যারও ঐ জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ পরেই বলে উঠলেন,‘কি হল কথা কানে গেল না?যাও বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।’ 
ক্লাসের সব শ্বাস প্রশ্বাস যেন এক নিমেষে থেমে গেল।এক জমাট নিস্তব্ধতা পুরো ক্লাসটাকে গ্রাস করে নিলে অম্বর আস্তে আস্তে নিজের বেঞ্চ ছেড়ে বাইরের দরজার দিকে পা বাড়াল। ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা, ছেলেদের পাশে মেয়েরাও দেখছে।পরে নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে আলোচনা করবে।শরীর আর সায় দিল না।চোখ দুটো ভিজে গেছে।দরজা পর্যন্ত একরকম চোখদুটো বন্ধ করেই গেল।বন্ধ চোখের পাতা চুয়ে গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ক্লাসের অন্য সবার এক জোড়া করে চোখের দৃষ্টির ভিতর দিয়ে অম্বর বেরিয়ে যেতেই স্যার আবার পড়াতে আরম্ভ করলেন।
অবশ্য খুব বেশিক্ষণ ক্লাসের বাইরে দাঁডাতে হল না।মিনিট পাঁচ,তাও অম্বর মাথা তুলতে পারেনি।পাশের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নিশ্চয় স্যারের গলা শুনতে পেয়েছে।ওভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতেও পেয়েছে। দেবদাস স্যারের কোচিংএ  ক্লাস সেভেনের একটা নতুন মেয়ে ভর্তি হয়েছে। অম্বরকে বেশ দাদা দাদা করে। এই স্কুলেই পড়ে।ও দেখতে পেলে আর দেখতে হবে না।ব্যাপারটা একটা বিচ্ছিরি জায়গায় চলে যাবে।স্যারও বকতে আরম্ভ করবেন।বিনা পয়সায় পড়ায় বলে অম্বরও কিছু বলতে পারে না।কিন্তু কি করা যাবে?এরপর তো ইতিহাসের ক্লাস মানেই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা।
বাবাকে দিন কয়েক আগে মা ফুলপান্টের কথা বলেছিল।বাবা বলেও ছিল,‘মাস’দুই দেরি হবে।মহাজনের কাছে একটা দেনা আছে, আগে মেটায়, এখন খরচ করে নিলে খেতে পাবো না।এতেই মাসের শেষে ধার হয়ে যাচ্ছে।’
অম্বর বাবার সব কথা শুনতে পেলেও কিছু বলে নি।বাবা সারাটা দিন সাইকেল চেপে প্লাস্টিকের জিনিস বিক্রি করে।এই গ্রাম থেকে ঐ'গ্রাম,এই শহর থেকে ঐ’শহর।তারপর বাড়ি ফিরে ক্লান্ত হয়ে যায়। অম্বর বাবাকে কিছু বলতে পারে না। আগের ক্লাস অবধি অম্বর হাফ প্যান্ট পরেই এসেছে।এখন খুব লজ্জা করে।ক্লাসের মেয়েগুলো কেমন করে চেয়ে থাকে,শীত গ্রীষ্ম সব সময় অসুবিধা।অন্য স্যাররা কিছু বলেন না।কিন্তু অমলেন্দু স্যার তো বলবেন।
পরের দিন স্কুল বেরোনোর আগে অম্বর নীল হাফ প্যান্টটা পরে তার ওপরে মামার দেওয়া গত বছরের ফুল প্যান্টটা পরে নেয়।প্রথম দুটো পিরিয়ড সামনের বেঞ্চে বসে থার্ড পিরিয়ডে লাস্ট বেঞ্চে চলে আসে।তারপর বসে বসেই ফুল প্যান্ট খুলে আস্তে আস্তে হাফ প্যান্ট পরে বসে থাকে। অমলেন্দু স্যার ক্লাসে ঢুকে অম্বরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,‘কি বাবা আজও কি স্কুল ড্রেশ পরে আসনি?’
অম্বর কোনো উত্তর না দিলেও পাশ থেকে সুনয়ন বলে উঠল,‘স্যার,ও ড্রেশ পরেই এসেছে।’
-তা বাবা কালকে যে বলছিলে তোমার বাবা বলেছে দুমাস পরে প্যান্ট কিনে দেবে,আর আজকেই চলে এলে। 
-না স্যার, ও হাফ প্যান্ট পরে আছে। অম্বরের পাশে বসা সুনয়ন আবার উত্তর দেয়।
স্যার চুপ করে গেছিলেন এমন সময় ফাস্ট বয় বলে উঠল,‘স্যার অম্বর তো আজও কালো প্যান্ট পরেই স্কুল এসেছে,আমি নিজে দেখেছি।’
-তাহলে যে সুনয়ন বলল।বেরিয়ে আয় দুজনে বেরিয়ে আয়।মিথ্যা কথা বলে বন্ধুকে বাঁচানো হচ্ছে।
ক্লাস থেকে আওয়াজ উঠল স্যার ছেড়ে দিন। 
-ছেড়ে দিন মানে! স্কুল ড্রেশ পরে স্কুলে আসবে না, তারপরে আবার মিথ্যা কথা বলবে। আর তোরা বলবি ছেড়ে দিতে। আমি অমনি ছেড়ে দেবো? 
অম্বর সুনয়ন দু’জনেই আস্তে আস্তে বেরিয়ে ক্লাসের মাঝখানে দাঁড়াল।অম্বরের দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লেও মুখে একটা কথাও বলল না। সুনয়ন ফুল প্যান্ট পরে এলেও অম্বর হাফ প্যান্ট পরে এসেছে। শীতের হাওয়াতে তার পায়ের লোমগুলোও কুঁকুড়ে গেছে। 
স্যার সব কিছু দেখে ফাস্ট বয়ের দিকে কটকট তাকিয়ে বললেন,‘তবে যে তুই বললি ও স্কুল ড্রেশ পরে আসেনি?তুই মিথ্যা বলছিস?গার্জেন কল করব?’
-সরি স্যার।ফাস্ট বয় উত্তর দিল।
স্যার তারপরেই দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন,‘যা তোরা বোস।ফুল প্যান্টটা পরে নে।ঠাণ্ডা আছে।’
-কিন্তু স্যার আমার প্যান্টটা যে স্কুল ড্রেশের নয়।
-সেটা আমি বুঝে নেব।পড়া বের কর অনেক সময় নষ্ট হল।
পরের দিন স্কুলে অমলেন্দু স্যার এলেন না।মনিটর ষ্টাফরুমে গিয়ে খবরটা শুনতে পেল।অম্বর অবশ্য কালো প্যান্ট পরেই স্কুল এসেছে।ক্লাসও হল।ছুটির পর স্কুল মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতেই একটা গাছের নীচে অমলেন্দু স্যারকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল।অম্বর কাছে যেতেই স্যার হাসি হাসি মুখ করে ডেকে বললেন,‘তোর জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি।’ অম্বর কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই একটা প্যাকেট অম্বরের হাতে দিয়ে বললেন,‘পরে দেখবি, ছোট বড় হলে বলবি পাল্টে দেব।’ 
অম্বর একটু অবাক হয়ে প্যাকেটটা নাড়াচাড়া করে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,‘এটা কি স্যার ?’
-তোর জন্য একটা ফুল প্যান্ট নিয়েছি, স্কুল ড্রেশের।এটা কিনতেই তো আজ দেরি হয়ে গেল।তাই আজ স্কুল গেলাম না।পরবি,আর শোন,কাউকে কিচ্ছু বলতে হবে না।বাড়ি যা,আমারও দেরি হয়ে যাচ্ছে। এবার দেরি করলে আর ট্রেন পাবো না।’

সাহিত্যিক ঋভু চট্টোপাধ্যায়
দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ










0 Comments