টাঙ্গন জোড়া জল ~ শর্মিষ্ঠার ছোটগল্প


শর্মিষ্ঠার ছোটগল্প 
টাঙ্গন জোড়া জল

"চুড়ি নেবে চুড়ি ই ই ই... ,কাঁচের চুড়ি"
রোজ দুপুরে আমার ফ্ল্যাটের নিচে ফুটপাত ধরে হেঁটে যায় ঝন্ ঝন্ শব্দরা একই ছন্দে। প্রায় দিন পনেরো হবে শুরু হয়েছে এই নতুন ঝঙ্কার। আশ্বিনের ডাক। বারান্দার উইন্ড চাইমের সরু ফাঁপা নলগুলোর টুং টুং শব্দে ষড়যন্ত্র আর একটা পোষা চড়ুই এসে লুচিপাতা গাছের সরু শীষগুলোকে খুঁটে দিয়ে যায়। পোষা এই অর্থে বললাম, ওর গায়ে কেউ কোনোদিন রবীন ব্লু'র নীল রঙের মতো কিছু নজরটিকা লাগিয়ে দিয়েছিলো হয়তো। পিঠের কাছে সেটাই জ্বলজ্বল করে। দেখলেই চিনতে পারি আমার নীলু'কে। জেড প্ল্যান্টের টবের মাটিতে কয়েকটা লুচিপাতা গাছ হয়েছে। কেমন করে এলো সেটা আমার অজানা। হয়তো ওই নীলু'ই ঠোঁটে করে এনেছিল ওর বীজ। চুড়িওয়ালার ডাকে বরাবর আমার মনটা কেমন উদাসী হয়ে যায়। এই সময়টা বীরেন বা আমার সুপুত্র ইমন কেউই বাড়ি থাকে না।একজন অফিস অন্যজন কলেজ। অতএব, এ দুপুরের আমি একলা ডাহুক।

বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। আমাদের 'কৃষ্টি টাওয়ার' এর স্যান্যাল বৌদিদের কাজের মেয়েটা রোজ এইসময় মেইন গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় আর ডানদিকে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে ছায়ায় দাঁড়িয়ে চুড়ি দেখে, কাঁচের চুড়ি। যত না চুড়ি দেখে, তার চেয়ে বেশী ঢলে পড়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলে। আর ওর শাদা দাঁতের ফাঁকের শাদা হাসি রোদ্দুরের মতো ছড়িয়ে যায়। বেগুনি শাড়ি লাল পাড়, আঁচল কোমরে গোজা, হাতখোঁপা। হাতে শাঁখা আছে বটে ! কিন্তু স্বামী নেয় না হয়তো ! 'কাজের মেয়েদের ওমন গা-ঢলানি স্বভাব থাকে। আমার তাতে কী ! কাজে প্রত্যেকদিন আসলেই হলো। বাইরে যা খুশি করুক।' সাফ উত্তর স্যান্যাল বৌদির। সেদিন রুনু ভালো মনে বলতে গিয়ে শুনে এসেছে।রুনুর সাদা মনে কাদা নেই বলেই জানতাম। বেচারা উপকার করতেই গিয়েছিলো। মনে মনে ভাবলাম, হাসিটুকু বেঁচে থাক দুপুররোদে। ভাতফুল হয়ে ফুটে উঠুক কোনো নিরণ্ন দিনে ওদের মাঝখানে।

ঘরে এলাম। আমার লেখার টেবিলের এককোণে পিতলের পানের বাটা রাখা আছে।ওতে আমি কালি শেষ হয়ে যাওয়া কলমগুলো রাখি। টেনে কাছে আনলাম। দেখি কলমগুলো আস্তে আস্তে সবুজ পানপাতা হয়ে যাচ্ছে।ঈষৎ সিক্ত।গায়ে ছোট্ট ভেজা গামছার টুকরো জড়ানো। রাঙাপিসি আলতো করে গামছা সরিয়ে একটা পান বের করে বাকিটা অপত্যস্নেহে মুড়ে রেখে দিলো। তর্জনীতে চুন লাগানো।পা ছড়িয়ে বসে কোলে পানটা রাখলো। তারপর ওই তর্জনীটা ওভাবেই উঁচু করে রেখে যাঁতা দিয়ে কাঁচা সুপারী কেটে পানের ওপর ফেললো। কচ কচ শব্দ। কাটতে কাটতে একটা সরু ফালি আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। তৎক্ষণাৎ 'না'। ওসব খেলে আমার মাথা ঘোরে। একটুকরো খয়ের আগেই ছিলো পাতায়, এখন সেটায় চুন লাগিয়ে এদিক সেদিক কোনোমতে মুড়ে বিরাট গহ্বরে চালান করে দিলো। আঙ্গুল থেকে সামান্য চুন দাঁতে লাগিয়ে চেবাতে থাকলো ধীরে, খুব ধীরে।ভেতর গালে টোপলা। আর একটু পরে গালসি দিয়ে লাল টুকটুকে নেমে আসবে। রাঙাপিসির রাঙা ঠোঁটদুটো আরো আরো রাঙা হয়ে উঠবে। আর আমাকে পাশে নিয়ে কাঠবিড়ালির সাথে নদীর পাড়ের সেই লুকোনো গল্পগুলো বলবে। আমি রাঙাপিসিকে কখনো বেগুনি শাড়ি পড়তে দেখিনি। শাড়িটা শাদাই ছিলো। তাতে রঙিন সুতো দিয়ে কোলাজ আঁকতো রাঙাপিসি।

আমার তখন আট, রাঙাপিসির পঁয়ত্রিশ হবে। স্কুল ছুটি থাকলে বাবার সাথে গ্রামের বাড়িতে যেতাম। মেজকা, ছোটকা, ঠামু, দাদু আর রাঙাপিসির ব্যস্ত হুল্লোড়। আমার রান্নাবাটি খেলার সাথী ছিলো রাঙাপিসি। কোত্থেকে কাঁটা ঝোপের বড় বড় পাতার নিচে গুচ্ছাকারে ঝুলতে থাকা ক্ষুদ্র বেগুনের মতো থোকা তুলে আনতো, লুচিপাতা আর সরু ছোট্ট ঢেঁড়সের মতো দেখতে কিছু ফল। পরে আমার ছেলের কাছ থেকে জেনেছি ওগুলো সোলানেসি ফ্যামিলির গাছ। তারপর আমরা রান্না করতাম পেয়ারা গাছের নিচে। প্রত্যেকদিন মেজকার বন্ধু সিতাংশুকাকা আসলেই রাঙাপিসির অমন ফর্সা টুকটুকে গালদুটো কেমন আরো লাল হয়ে যেত। আর রাঙাপিসি আমার আরো কাছে ঘেঁষে বসে রান্নাবাটি খেলায় ভুল করতো বারবার। ব্যাস এইটুকুই। তারপরের আর কিছু আমার জানা নেই। একবার খুব বর্ষায় টাঙ্গনের ধারে আমরা সবাই ঘুরতে গিয়েছিলাম। সিতাংশুকাকাও গিয়েছিলেন আমাদের সাথে। খুব সুন্দর ছবি আঁকতেন কী না ! টাঙ্গনের ধারে একটা আর্টপেপারের বান্ডিল খুলতেই দু'একটা উড়ে গিয়েছিলো দূরে, ঝোড়ো হাওয়ায়।আমি দৌঁড়ে কুড়োতে গিয়ে দেখি একটা আর্ট পেপার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাঙাপিসি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে আর অনতিদূরে স্থির দৃষ্টি সিতাংশুকাকার। অসহায়, অপরাধী সেই দৃকপাত। হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি। নদীর জলগুলো ছোট ছোট পিরামিড হতে হতে শুধু তরঙ্গ হয়ে গেলো। আমি স্পষ্ট দেখলাম রাঙাপিসি হাতে ওই আর্টপেপার নিয়ে সিতাংশুকাকার কাছে এলো, একদম কাছে।পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেই ছুট।গোল্লাছুট নদীর দিকে। নাঃ, কেউ ধরতে পারেনি। না বাবা, না মেজকা, ছোটকা কেউ।ঘটে গেলো অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিত ঘটনা। সিতাংশুকাকা বিমূঢ় দাঁড়িয়েছিলো ওই একই জায়গায়।কতক্ষন, কতঘন্টা, কতদিন কেউ জানে না। হয়তো এখনো দাঁড়িয়ে আছে !

আমি পানের বাটার পেছনে রাখা ফ্রেমটা টেনে আনলাম নিজের কাছে। আজ তেরো'ই আশ্বিন। চন্দনের ফোঁটা লাগাবো কাঁচের ওপরে। ঘড়িতে ঢং ঢং করে তিনটের ঘণ্টা বাজলো। ফুলে যাওয়া শরীরের আমার রাঙাপিসির অচেনা অবয়ব যখন পুলিশকাকুরা টেনে তুলেছিলো নদী থেকে তখনও সময় ছিলো দুপুর তিনটে। আমি এখনো বুঝতে পারিনি চন্দনের ফোঁটায় ফটোফ্রেমের কাচ সাজানোর অর্থ আসলে কী ! রাঙাপিসির শাড়িটা কিন্তু তখনো শাদাই ছিলো আর এখনো শাদাই আছে পঁয়তাল্লিশ বছর পরেও।
ফ্রেমটা বুকের কাছে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 
'রাঙা, কাঁচের চুড়ি পড়বি ?'
কই,কেউ উত্তর দিলো না তো ! আবার জিজ্ঞাসা করলাম,
'রাঙা, বেগুনি শাড়ি পড়বি ?'
কোনো উত্তর নেই।
শুনতে পেলাম সেই ডাক 'চুড়ি নেবে গো, চুড়ি ই ই...'। মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। অনেক দূরে, টাঙ্গনের ধারে, সিতাংশুকাকা আর্ট পেপার নিয়ে বসে আছে, তুলি ভিজে যাচ্ছে নদীর জলে আর আমার রাঙা আলতা পায়ে ধীরে ধীরে নামছে নদীর ঘাটে, শাদা হয়ে যাচ্ছে নদীর জল, দিব্যি শুনতে পাচ্ছি সেই শাদা হাসি টুপটুপ করে ঝরছে শিউলির সাথে। এখন ভরা আশ্বিন।

সাহিত্যিক শর্মিষ্ঠা সাহা 
২৭, পুলিন অ্যাভিনিউ, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ 







0 Comments