লিভ টুগেদার ~ মুক্তি দাশের অণুগল্প


মুক্তি দাশের অণুগল্প 
লিভ টুগেদার 

আজ উৎপলদের গৃহপ্রবেশ। অবশ্য বিশাল মাল্টি-কমপ্লেক্সের তিনতলার উত্তর-পূর্ব কোনে সাড়ে-আটশ’ স্কোয়ারফিটের টু-বিএইচকে ফ্ল্যাটকে যদি ‘গৃহ’ বলা যায়! 

উৎপল আমার ছোটবেলার বন্ধু। দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়ার কাছাকাছি একটা রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের কমচারি। বছর সাতেক হলো বিয়ে করেছে। 

বউ শর্মিলা কাছেই বাচ্চাদের আধা-ইংরেজি স্কুলে পড়ায়।  একটিমাত্র মেয়ে স্নেহা। ফাইভ-প্লাস। ভীষণ জলি। আমার মেয়ে ঝিলিকরেই বয়সী। শুধু মাথা গোঁজার মতো নিজস্ব একটা ঠাঁই ছিল না। ব্যাংক থেকে লোনের সুবাদে এবার তাও হয়ে গেল।

নরেন্দ্রপুরের সুগমপার্কে ছিমছাম ফ্ল্যাট। পরিচ্ছন্ন নিরিবিলি পরিবেশ। ওদের নতুন ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে আজ আমরাও নিমন্ত্রিত। তবে আয়োজন খুবই সীমিত। অল্প কয়েকজনকে ডাকা হয়েছে। উৎপলের ব্যাংকের  কিছু কলিগ, দু’চারজন নিকট-আত্মীয় আর বন্ধুদের মধ্যে তিন-চারজন। আর আমরা আড়াইজন। মানে আমি, তৃণা এবং আমাদের একমাত্র মেয়ে ঝিলিক।

সকাল দশটার মধ্যেই আমরা সপরিবারে উৎপলদের ফ্ল্যাটে হাজির। আমাদের দেখে উৎপল-শর্মিলা হইহই করে উঠল। তৃণার হাত ধরে শর্মিলা জোর করে ধরে  নিয়ে গেল ভেতরের ঘরে। আমরা ড্রইংরুমে সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। উৎপলের মেয়ে স্নেহা এসে টানতে টানতে নিয়ে গেল ঝিলিককে। ওরা পূর্ব-পরিচিত। এবং বন্ধুও।

সারা-দুপুর পুজো-আচ্চা, গল্প-আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া সারতে সারতে ঘড়ির কাঁটা একসময় যখন চারের ঘর ছুঁইছুঁই, আমরা উঠে পড়লাম। অতিথি-অভ্যাগতরা ইতিমধ্যে অনেকেই বিদায় নিয়েছেন। এবার তো আমাদেরও উঠতেই হয়। কিন্তু ঝিলিক কোথায় গেল? গলা চড়িয়ে দু’বার ‘ঝিলিক ঝিলিক’ ডাকতেই শর্মিলা মুচকি হেসে ফোড়ন কাটল, ‘বাব্বা, আপনার তো দেখছি মেয়ে অন্ত প্রাণ! মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে কী করবেন?'

তারপর একটু থেমে বলল,  'দেখুন না, ওরা দু’টিতে হয়তো ব্যালকনিতে বসে খেলছে। আহা! কতদিন পর দুইবন্ধুতে দেখা হল বলুন তো!’

সবাই মিলে ব্যালকনিতে গেলাম। সত্যিই ওরা খেলছে। দুটি শিশু মনযোগ দিয়ে আপনমনে খেলছে। পুতুল নিয়ে খেলছে। একটা পুতুলকে রঙিন-রুমালের শাড়ি পরানো হয়েছে। আর একটা পুতুলের গায়ে ছেলেদের পোশাক। নিশ্চয়ই ওরা বিয়ে-বিয়ে খেলছে। দৃশ্যটি মুহূর্তে ওদের, বিশেষ করে তৃণাকে, খুব নস্ট্যালজিক করে তুলল। ছোটবেলায় ওরাও তো এরকমই পুতুল নিয়ে বিয়ে-বিয়ে খেলত।

আমি এবার গলা খাঁকারি দিয়ে এগিয়ে গেলাম। বললাম, ‘কিগো, তোমরা দুই বন্ধুতে কী করছ? বিয়ে-বিয়ে খেলছ বুঝি? বাঃ! খুব ভাল, খুব ভাল!’

পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে খুশিখুশি গলায় তৃণা বলল, ‘জানিস, আমরাও না ছোটবেলায়…’

ওকে থামিয়ে দিয়ে ঝিলিক গম্ভীরভাবে কেটে কেটে বলল, ‘আমরা মোটেই বিয়ে-বিয়ে খেলছি না, মাম্মি!’

তৃণা উৎসুক হল। বলল, ‘ওমা! তবে কী খেলছিস?’

এবার ফিক করে হেসে দিয়ে স্নেহা বলল, ‘আমরা লিভ-টুগেদার লিভ-টুগেদার খেলছি, আন্টি!’

সাহিত্যিক মুক্তি দাশ 
১৩৫, অঘোর সরণী, রাজপুর, কলকাতা



0 Comments