
অরুণআলো
একটা উঁচু মঞ্চ। একটা মোম লাগানো ফাঁসির দড়ি।এক নির্ভীক আঠারো মাথা উঁচু করে এগিয়ে চলেছে মঞ্চের দিকে।তার পিছমোড়া করে বাঁধা হাতে বারুদের গন্ধ,চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন আর মুখে গান--একবার বিদায় দে মা,ঘুরে আসি।জেলের উঁচু পাঁচিল পেরিয়ে সে গান ছড়িয়ে পড়ছে বাংলার কোণায় কোণায়।জেগে উঠছে মানুষ।
দুম!প্রচন্ড শব্দে দিবানিদ্রা ভেঙে চমকে উঠল অরুণ।বুকের ওপর খোলা বই--বইয়ের পাতায় ফাঁসির দড়ি পরা বীর বিপ্লবীর ছবি।
কিন্তু বোম ফাটার বিকট শব্দ আর মাইক্রোফোনের প্রবল দৌরাত্ম্যে স্বপ্নে পাওয়া আশ্চর্য বেদনটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল মুহূর্তেই।পাড়ার ক্লাবে মদ-মাংস সহযোগে চলছে স্বাধীনতার দ্বিপ্রাহরিক বিশেষ উদযাপন।
মা'র ত্রস্তব্যাকুল ডাকে ছুটে গেল অরুণ।নার্সিংহোম থেকে সদ্য হার্টের অপারেশন সেরে ফেরা মানসবাবুর তখন হাঁসফাঁস অবস্হা শব্দদৈত্যের প্রবল তান্ডবে। মার মুখে ফুটে ওঠা অসহায়তার ছবিটা অরুণকে টেনে নিয়ে চলল শব্দের উৎসের দিকে।
সেখানে তখন মদ,মাংস,নাচ আর গানের মাঝে অসহায়ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন বীর বিপ্লবীরা।ক্লাবের বাইরে ম্রিয়মান তেরঙা পতাকায় ঝুলে আছে অচেনা বিষাদ। মিনতিমাখা আবেদনের উত্তরে একটা কঠিন থাপ্পড়ের চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল অরুণের গাল জুড়ে।
উত্তাল হাসির হুল্লোড় তাকে ধাক্কা মেরে ঠেলে দিল দরজার দিকে।হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ার সময় সেই বেদনমাখা সুরটা যেন আবার বেজে উঠল হৃদয় জুড়ে।।চোয়াল শক্ত করে মিউজিকের নবটা ঘুরিয়ে দিল অরুণ। হঠাৎ স্তব্ধতায় ভীষণ অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ওরা। দল বেঁধে এগিয়ে আসছে অরুণের চারিদিকে--অন্ধকার বৃত্তের মতো।মেঝেতে পড়ে থাকা ফটোগুলোয় পশ্চিমের আলোর কারিকুরি।সেই আলো এক আশ্চর্য গানের সুর হয়ে উত্তাল সাগরের ঢেউ -এর মতো বার বার আছড়ে পড়তে লাগল অরুণের মনে প্রবল বিক্রমে।
গল্পকার শুভ্রাশ্রী মাইতি
মহিষাদল, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ
0 Comments