সবুজ রংয়ের হিংসে আর অষ্টমীর অঞ্জলি
পুজো আসছে মানেই কাশফুল, আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘ, বীরেন্দ্র ভদ্রের স্তোস্ত্রপাঠ,গড়িয়াহাটের মার্কেট আর খবরের কাগজে পাতা জোড়া জুতোর বিজ্ঞাপন। ছোটোবেলায় যদিও পুজো আসার এই গন্ধটা উপভোগ করার মতো সুযোগ আমাদের খুব একটা ছিল না। মিড ডে মিল, পাশ-ফেল প্রথার অবলুপ্তি, ইউনিট টেস্টের যুগের অনেক আগে ঠিক পুজোর আগে আগেই হতো হাফ-ইয়ারলি পরিক্ষা। শেষ হতো ঠিক ষষ্ঠির দিন। নব্বই দশকের শেষ দিকে তখন পরিক্ষায় পাশ করার লক্ষ্যে অন্ধ আমাদের কাছে পুজোর গন্ধ বলতে ছিল বাড়ি ফেরার পথে প্যান্ডেলের বাঁশ ধরে দোল খাওয়া (তখনও পুল-কার শুরু হয়নি)। ষষ্ঠীর দিন হতো মৌখিক পরিক্ষা। আর মহালয়ার পরেরদিন অবশ্যম্ভাবী সবচেয়ে শক্ত—অঙ্ক পরিক্ষা। পরিক্ষার পড়া মুখস্থ করতে করতে পুজোর গন্ধ বলতে ছিল শুধুই একদিন—পুজোর বাজার। সেটা হওয়ার পর থেকেই বাড়ির কাজের মাসি থেকে প্রাইভেট টিউটর সবার একই প্রশ্ন—ক’টা হলো? হাফ প্যান্ট থেকে ভাঙা গলার নায়ক হয়ে ওঠা সেই সময়টা আমাকে ঘিরে থাকতো একটা সবুজ রংয়ের হিংসে। হিংসে, সোমনাথকে নিয়ে। সোমনাথ আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। ফার্স্ট বেঞ্চে পাশাপাশি বসলেও, টিফিনে স্কুলের গেটের ফাঁক দিয়ে এক টাকার ঘুঘনি ভাগ করে খেলেও, পরিক্ষার সময় আমার সবুজ হিংসেটা ঠিক বের হয়ে আসতো। সারাবছর ক্লাবে আড্ডা দিয়ে, চুটিয়ে ক্রিকেট খেলে, গল্পের বই পড়ে কীভাবে ও ফার্স্ট হয়ে যেত, বুঝতেই পারতাম না। ও ব্যাটার জন্যই স্কুলে আমার কোনোদিন ফার্স্ট হওয়া হলো না।
সে সময় আমার কাছে পুজো ধরা দিত আনন্দমেলা পুজোবার্ষিকী’তে। হাফ-ইয়ারলি পরিক্ষা শেষ। পড়াশুনোর চাপ নেই। সারা পুজোর ছুটি টিনটিন-অরণ্যদেবের কমিক্স। কাকাবাবু- মিতিনমাসি’তে বুঁদ হয়ে থাকতাম। দুর্গাপুজোর চারটে দিন অদ্ভুত এক আনন্দ। হঠাৎ করে বড়ো হয়ে যাওয়া। সারা বছর বড়োদের হাত ধরে রাস্তা পাড় হওয়া আমরা,বন্ধুরা দিব্যি ঘুরে দেখতাম বাগবাজার, একডালিয়া, বাবুবাগান বা গড়িয়ার নবদূর্গা। রাস্তার ধারে হঠাৎ গজানো দোকান থেকে কুমড়োর সসে ভেজা চাউমিনে দিব্যি হয়ে যেত লাঞ্চ বা ডিনার। আরও একটু ছোটো বয়সে পকেটে তখন রিভলবার, ক্যাপ ভরা।
কম বয়সীরা তরতর করে উঁচুতে ওঠে পড়ে। অনেক সময় দু-তিন ধাপ টপকে। আমরাও ছোটোবেলায় বড়ো তাড়াতাড়ি বড়ো হয়েছি, মানে হতে চেয়েছি। সারা বছর পরে থাকা হাফ প্যান্ট যখন পুজোর সময় ফুল প্যান্ট হয়ে যেত, তখন সত্যি বড়ো হয়ে যেতাম। বন্ধুরা মিলে ঠাকুর দেখা—বড়ো হয়ে যাওয়া। দুম করে বড়ো হয়ে গেলাম মাধ্যমিক দেওয়ার পরই। ভালো রেজাল্ট করে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম বিজ্ঞান নিয়ে। সব ভালো ছেলেরাই তাই করে। এ এক অলিখিত নিয়ম। পড়াশুনোয় ভালো হলে বিজ্ঞান, মাঝারি কমার্সে আর ঝড়তি পড়তিরা আর্টসে। এই আমার প্রথম ‘সোমনাথ’ ফাঁড়া কাটলো। ইমামবাড়ার সামনে চায়ের দোকানের মালিক সোমনাথের বাবার ছেলেকে সায়েন্স পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না। তাই সোমনাথের অবশ্যম্ভাবী কমার্সে ভর্তি। তবু কিন্তু সবুজ রংয়ের হিংসেগুলো রয়েই গেল। ও কেন কমার্সে গেল! আমার ফার্স্ট হওয়াটা কেমন তেতো হয়ে গেল। ততদিনে সোমনাথ ওদের পাড়ার বড়ো পুজোটার কেউকেটা কর্মকর্তা। গলায় রীতিমত ব্যাজ ঝুলিয়ে ভিড়ের সামনে দড়ি ধরে। lমাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট করে--‘...নিজে প্রতিমা দর্শন করুন ও অন্যকে দর্শনের সুযোগ করে দিন’। ক্রমশ ক্যালকুলাস বুঝে ওঠা আমরা সোমনাথের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছি সপ্তমী টু দশমী, ফুচকা খেয়েছি, ঝিঙ্কু মামনি দেখেছি। শূন্য দশকের একেবারে গোড়ায় পুজো আমাদের বড়ো করে দিয়েছে তিন চারটে সিঁড়ি টপকে। এই পুজোতেই প্যান্ডেলের পিছনে প্রথম সিগারেটে টান। দশমীর দিন ঢাকের সাথে উদ্দাম নাচ। ‘বলো দূর্গা মাঈ কী...’।
আমাদের বড়ো হয়ে ওঠা পুজোর সাথেই। অষ্টমীর অঞ্জলিতেই চোখে চোখ। কোমরে গামছা বেঁধে ভোগ পরিবেশন—আর একটু দিই। পুজো মানেই আমার কাছে ছিলো নাটকে অভিনয়। মনোজ মিত্রের ‘চোখে আঙুল দাদা’, ‘সত্যি ভূতের গল্প’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভাড়াটে চাই’ বা ‘ভীমবধ’ —এক এক বার পুজোয় একে একটা নাটক। স্টেজ কভার করতে হয় কীভাবে, মাইক্রোফোনের ব্যবহার—একে একে শিখিয়ে দিয়েছে পুজোগুলো। গ্রীনরুমের সেই টেনশন বা প্রম্পটারের কথা শুনতে না পারা, দর্শকের সিটি—এই সব উত্তেজনাগুলো আজও ভিড় করে আছে স্মৃতিতে।
আরো একটু যখন বড়ো হয়েছি, জড়িয়ে পড়েছি নিজের পাড়ার পুজোর সাথে। বিল বই হাতে চাঁদা কাটা, ঠাকুর আনা, বোধন, সন্ধিপুজো। পুজোর প্রতিটা ক্ষণ যেন বারে বারে ধরা দিত তখন। আমাদের পাড়ার পুজোয় ঢাকি আসতো বর্ধমানের কেতুগ্রাম থেকে। প্রতি বছর পুজোর আগে পুরোহিত থেকে ডেকরেটার্স, লাইটম্যান থেকে কুমোর—সবাইকে বায়না করতে হয়। করতে হয়না শুধু আমাদের এই ঢাকিকে। কোনো যোগাযোগ নেই, ফোন কল নেই; কিন্তু এখনো প্রতিবছর পঞ্চমীর দুপুরে ঠিক শুনতে পাবো—ড্যাম কুড়া কুড় ড্যাম। অষ্টমীর সকালে মেয়েদের শাড়ি পড়াটা মাষ্ট। মাইকে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ আর এদিকে ফুল-বেলপাতা হাতে বুঝতে না পারা মন্ত্র বিড়বিড় করে যাওয়া। শেষলগ্নে শুধু কমন পাওয়া প্রশ্নের মতো গলা চড়িয়ে—নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমঃ নমঃ। দুপুরে পাড়া জুড়ে একসঙ্গে খাওয়া। পিকনিকটা বিদেশী-বিদেশী আর বনভোজনটা বড্ড বুনো। অষ্টমীর ভোগ নিয়ে কোনো কথা হবে না বস্। সারা পাড়ার গেট-টুগেদার। খাওয়া শেষে খালি চেয়ার দখল করে দেদার অন্ত্যাক্ষরী।
আস্তে আস্তে বদলে গেছে অনেক কিছুই। সাবেকীয়ানা বদলে গেছে থিমের পুজোয়। পুজোর আগের এই সময়টা এখন সারা কলকাতা জুড়ে দুগ্গা পুজোর বিজ্ঞাপন। মা দুর্গাও এখন বিজ্ঞাপন দিয়ে ভক্ত চাইছে। পুজো এখন বাড়তে বাড়তে মহালয়া টু লক্ষ্মীপুজো। দুর্গাপুজোর জগতে বিপ্লব এসেছে বারবার। একডালিয়ার বিশাল ঝাড় দেখে জনগণ ঢুকে গেছে বোসপুকুরের বিস্কুটের প্যান্ডেলে। নাকতলা উদয়নের কাঠের দুর্গা টু সুরুচি’র ‘চলুন বেড়িয়ে আসি’। পুজো এলেই এখন খোঁজ পড়ে স্পেশাল পাসের। বড়ো পুজোর ভিআইপি পাস দেখিয়েই এ পাড়ার ঝন্টি’কে পটিয়ে নিলো ও পাড়ার পাপাই।
এখন আমার পুজো আসে বোনাসের খবর নিয়ে। গড়িয়াহাট-হাতিবাগান-প্যান্টালু ন্স-বিগবাজার ঘুরে পুজোর শপিং। মহালয়া যেতে না যেতেই বাড়ির লোককে নিয়ে ভিড় হওয়ার আগেই দেখি ফেলি পুজো। গর্ব ভরে বন্ধুকে হোয়াটস্য়্যাপে পাঠাই পিছনে বড়ো দুর্গাকে নিয়ে দেশপ্রিয়’র মাঠে আমার সেলফি। হুহু বাওয়া, পর্দা দেওয়ার আগেই। বাকি দিনগুলো একটু মাটন-ভাত খেয়ে বিশ্রাম। অফিসে বড্ড চাপ যাচ্ছে আজকাল। অষ্টমীর দিন সকালে আমার বউ-মেয়ে নতুন শাড়ি পড়ে অঞ্জলি দিতে যায়। আমি অঞ্জলি দিই না। ঘরে চুপটি করে নিজেকে লুকিয়ে রাখি। অষ্টমীর দিন সোমনাথের কথা হঠাৎ মনে পড়ে যায়।
সোমনাথ, আমার বন্ধু সোমনাথ ওদের পাড়ার বড়ো পুজোটায় স্বেচ্ছাসেবক ছিল। অষ্টমীর অঞ্জলীর ভিড় সামলাতে ওস্তাদ সোমনাথ, তেরো বছর আগে এক অষ্টমীর সকালে ভিড়ের ধাক্কায় প্যাডেস্টাল ফ্যানের উপর গিয়ে পড়ে। তড়িদাহত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। আমার জীবনের প্রথম বন্ধু-বিয়োগ। ত্রিবেণী শ্মশানে ইলেকট্রিক চুল্লির আগুন যখন সোমনাথকে জড়িয়ে ধরছে তখন আমাদের চোখ শুষ্ক হয়ে গেছে। কান্নার জল বোধ হয় সেদিন দুঃখকে পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারেনি। ইলেকট্রিক চুল্লির চিমনি দিয়ে সাদা ধোঁয়া বের হয়। কাঠে পোড়ালে হয়ত ধোঁয়ার রংটা সবুজ হতো, আমার হিংসার রং’য়ে।
এখন প্রতি বছর অষ্টমীতে সোমনাথের পাড়ার পুজোটায় যাই। এখনও প্যান্ডেলের এককোণে সোমনাথের বাঁধানো ছবি থাকে। রজনীগন্ধার মালা দেওয়া। মৃত্যুস্থল বলেই হয়তো ওকে ভুলে যেতে পারে না ক্লাবের লোকগুলো। আমি কী করবো আজও বুঝি না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। বন্ধুকে প্রণাম করতে হয় নাকি! মারা গেলে মানুষতো ভগবান হয়ে যায়। ভগবানকে তো প্রণাম করাই যায়। আমি কিছুই না করে পুরোনো কথাগুলো মনে করি। একসময় ভলেন্টিয়ার তাড়া দেয়। চমকে পিছনে ফিরে দেখি—সোমনাথ। নাহ্, অবিকল সোমনাথের মতো একটা ছেলে। ওরই মতো রোগা। সোমনাথ তখন কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো কাঁচের ওপাশে। মালা পরে হাসছে। আমি অষ্টমীতে মা দুর্গার সামনে অঞ্জলি দিই না। আমি অষ্টমীতে অঞ্জলি দিই সোমনাথের সামনে। ভালোবাসার অঞ্জলি। মানুষ মারা গেলে ভগবান হয়ে যায় যে।
0 Comments