সুষ্মিতা রায়চৌধুরীর ছোটগল্প
বাক্সবাড়ি
“কিরে পেলি ব্রাশ সেটটা?” চিৎকার করে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে শর্মিলা।কোনও উত্তর নেই ওদিক থেকে। এই নিয়ে দু’বার হাঁক মারে সে। তবুও কোনও উত্তর আসেনা রিওর দিক থেকে।
“ কিরে বাবা ছেলেটা গেল কই”, নিজের মনেই কথাটা বলে ছেলের ঘরে ঢোকে সে।ওমা কোথাও নেই দশবছরের রিও। চার মাস হল নিউজার্সি থেকে কলকাতা ফিরেছে শর্মিলারা। স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে নিয়ে রিওর অভ্যাস ছিল হেডফোনে নিত্য নতুন গান শোনা। কখনও বিটেলস্, কখনও জো দাসিন, কখনও বা মোর্জার্ট, আবার কখনও এলভিস প্রেসলি বা জন ডেনভার। ওইটুকু বয়সেই রিওর সুরের নেশা এমন যে এদেশে ফেরার আগেই নিউজার্সির একটা অনুষ্ঠানে মোর্জার্ট শুনিয়ে একবার তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সে সবাইকে। ভায়োলিন রিওর প্রিয় বন্ধু আর আঁকার ক্যানভাসটা যেন তার প্রাণ। তালিম চলতো নিয়ম করে। এটাই ছিল রিওর প্রিয় খেলা তখন।
“কিন্তু ছেলেটা গেল কই,” ভাবনাটা ধাক্কা খায় শর্মিলার।
বারান্দায় গিয়ে বাইরে মুখ বাড়াতেই সে দেখে আবার সেই এক জিনিষের পুনরাবৃত্তি। রিও প্রাণপন চেষ্টা করছে ফ্ল্যাটের অন্য বাচ্চাদের সাথে ফুটবলে সামিল হতে। হাঁপিযে যাচ্ছে, বল পায়েও লাগছে না তবুও আজকাল রোজ এই চেষ্টা চালাচ্ছে সে। বেশ অবাক হয় শর্মিলা। তার ছেলে তো এরকম আউটডোর গেম কোনওকালেই ভালবাসত না! যাইহোক আবার শুরু হয় ভায়োলিন বো, পেন্টিং ব্রাশ সেট খোঁজার চেষ্টা। কিন্তু তন্ন করে খুঁজেও কোথাও পায় না জিনিষগুলো শর্মিলা।
একঘন্টা পর ঘরে ঢুকে রিও টিভি চালায়। শর্মিলা লক্ষ্য করেছে আজকাল চলতি বাংলা সিনেমার গান খুব শোনে রিও। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি রিওর ভালবাসার কারণ শর্মিলা নিজেই। ভায়োলিনে বেশ কয়েকটা রবীন্দ্রসঙ্গীত তুলেছিল রিও। খুব আগ্রহ ছিল গানের অর্থ বোঝার।
“কিরে তুই জিনিসগুলো খুঁজেছিলি নিজের ঘরে?”
রিও বলে, “নাহ ওগুলো নেই আমার কাছে”
“তাহলে গেল কোথায় বলতো। আমি তো তোকেই ঢোকাতে বলেছিলাম ওগুলো এখানে আসার সময়। তুই কি ফেলে এলি সবকিছু?”
“তাই হবে”, নিরুত্তাপ উত্তর আসে রিওর।
যার সারাদিন কেটে যেত আঁকা আর ভায়োলিন নিয়ে সেই ছেলের কোনো হেলদোল নেই তা নিয়ে। রিও উঠে যায় টিভির সামনে নাচতে, “ দেখো মা এটা দেব”।
শর্মিলা যেন চিনতেই পারছে না তার নিজের ছেলেটাকে।
রিওর জন্ম থেকে বড় হয়ে ওঠা পুরোটাই নিউজার্সিতে। কোনওদিনই সে খুব দুষ্টু নয়।গল্প করতে ভালবাসলেও হাতে পায়ে খুব ধীরস্থির সে। শর্মিলা সবসময় আদর করে বলত, “ আমার লক্ষী ছেলে।”
কিন্তু আজকাল তার আচরণে বেশ পরিবর্তন দেখছে সে। রিওকে ভর্তি করেছে তারা কলকাতার বেশ নামকড়া একটা ইংরেজী মিডিয়ম স্কুলে। হঠাৎ শর্মিলার খেয়াল হয় স্কুলে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো রিওর। ছেলেকে কাছে টেনে সে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁরে স্কুল ভাললাগছে? ক’টা বন্ধু হল তোর?”
রিও খানিক চুপ করে থেকে বলে, “ স্কুল ভাল কিন্তু আমি এখানে একদম নতুন।”
“তাতে কি রিও, তুমিও মিশে যাবে ওদের সাথে আস্তে আস্তে।”
“ হমমম, কিন্তু আমি তো কোয়াইট। চুপচাপ থাকলে বন্ধু হবে কি করে মা?”
ধক করে ওঠে শর্মিলার বুকটা। “ কি হয়েছে রিও? কেউ কিছু বলেছে? তোমায় টিচাররা সাহায্য করে না?”
“ না না মা, ম্যামরা খুব ভাল। আমায় তো ফার্ষ্ট বেঞ্চে বসায় রোজ। কিন্তু আমার ভাললাগেনা।”
“ কি ভাললাগেনা?” প্রশ্ন করে শর্মিলা।
“ আমার ইচ্ছে করে লাস্ট বেঞ্চে বসতে। দুষ্টুমি করতে। ফুটবল খেলতে। লুচি মাংস খেতে। আমি তো এসব কিছুই পারি না। তাই...”
রিও ছোট থেকেই ডাল ভাত ঝোল, সব্জি খেতে ভালবাসে। ভাঁজা বা আমিষের প্রতি তার কোনও লোভ নেই। মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসলেও বাঙালি খাওয়ারের প্রতি সেরকম ভালবাসা নেই তার কিন্তু খাওয়া নিয়ে কোনও মতামতও নেই সেরকম।
“তাই কি রিও?” শর্মিলা শুধায় ছেলেকে।
টিভির দিকে তাকিয়ে রিও বলে, “ ওই দেখ মা স্টেচু ওফ লিবার্টি, নিউইয়র্ক। দেখ মা এখানেই আমার বার্থডে হয়েছিল। আরেকটু গেলেই আমাদের বাড়ি। ইসস যদি দেখতে পেতাম।”
একটা হিন্দি গানের লোকেশনে সেন্ট্রাল পার্ক দেখাচ্ছিল টিভিতে। সেগুলোই হাঁ করে গিলছিল রিও। নিউজার্সিতে রিওর বাংলা উচ্চারণের প্রশংসা করত সবাই। কিন্তু এখানে তার “ইংরেজি এক্সেন্টের” জন্য একঘরে হয়ে যাচ্ছে তার শৈশব। শর্মিলা বুঝতে পারছে রিওর বেশ অসুবিধা হচ্ছে সবকিছুর সাথে তাল মেলাতে কিন্তু প্রাণপন চেষ্টা চালাচ্ছে রিও বন্ধু হয়ে উঠতে সবার।
কিন্তু ঠিক কতটা অসুবিধা হচ্ছে সেটা বুঝতে পারেনা শর্মিলা।
রাতে রিও ঘুমিয়ে পড়ার পর শর্মিলা আজ যায় ছেলের ঘরে। দেখে অঘোরে ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। মাথার কাছে রাখা হেডফোনের তুলতেই সে শুনতে পায় হিন্দি একটা গান চলছে সেটায়। ক্যানভাস ফাঁকা পড়ে আছে একলা একটা কোণে। পা লাগে রিওর ছোট ট্রলিটায়। খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে ছিল কোণাটা। বাক্সটা খুলতেই দেখে সুন্দর করে গোছানো আছে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ছবি আঁকা রিওর সবথেকে প্রিয় “কম্ফোর্টার”। বিদেশে ছোট কম্বলকে এই নামে ডাকা হয়। সবকিছুতেই একটা ছন্দ মেলানোর চেষ্টা করে তার লক্ষী ছেলেটা। হেসে বাক্সটা বন্ধ করতে যেতেই কি যেন একটা হাতে লাগে তার। কম্বলটা চাপলেই সে বোঝে কিছু আছে সেটার ভিতরে। আস্তে করে শর্মিলা তার ভাজ খুলতেই সে খুঁজে পায় ভায়োলিন-বো, তুলি আর নিউজার্সির বাগানে ফোঁটা কিছু শুকিয়ে যাওয়া বিদেশী ফুল। সবকিছু এমন লুকিয়ে কেন রেখেছে রিও!
পাশেই দেখে রিওর ডায়েরিটা রাখা আছে। হাতে তুলে নেয় শর্মিলা সেটা। পাতা ওল্টায় সে সন্তর্পণে। চোখ আটকায় শেষ পাতায়।
“কেউ আমার বন্ধু হয়না এখানে।সবাই বলে আমি এন.আর.আই আর এটা নাকি আমার দেশ না।আমি লুচি খেতে ভালবাসিনা, বাংলা গানে নাচতে পারিনা, ফুটবল খেলতে পারিনা তাই কেউ মেশে না আমার সাথে। আচ্ছা ডায়েরি গানের দেশ কোনটা? আমি তো গান শুনি ভায়োলিনে সুর মেলাতে। টেগোর থেকে বিটেলস সবই তো একটা মিউজিকাল জার্ণি। তাদের আবার দেশ কি? ওরা বলে ‘ তুই ইংরেজ তুই আমাদের না’। আঁকতে ভালবাসি শুনলে বলে, ‘ হাউ বোরিং’। কিন্তু মা বলে আমি তো বাঙালি। নিউজার্সিতে আমি কত বাংলা কবিতা বলতাম, ঠাকুমার ঝুলি পড়তাম, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী শুনতাম। আমি তাহলে বাঙালী নই কেন? ওরা তো ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ে আমি তো ওই দেশে ‘বাংলা স্কুলেও’ পড়তাম। তাহলে ওরা বাঙালী আমি নই কেন? আমার ইংরেজীর উচ্চারণ নিয়ে ওরা ইয়ার্কি মারে কিন্তু এতে আমার দোষ কোথায়! আমি খুব চেষ্টা করছি এই দেশের মতন হওয়ার। কিন্তু ওই দেশটাকে আমি কোনওদিন ভুলতে চাইনা। তাই ওই দেশের মর্নিং গ্লোরি আমি নিয়ে এসছিলাম। আই লাভ ইউ কলকাতা বাট আই উইল নেভার ফরগেট ইউ নিউইয়র্ক। দুটো দেশ আমার হতে পারেনা? তাহলে আমার দেশ কোনটা? আমার দেশ খুঁজতে হবে আমায় এখন। ওদের মতন হলে তবেই বন্ধু হবে আমার। সরি ডায়েরি অনেক কাজ এখন। তাই আমি আমার নিউজার্সির পছন্দের জিনিসগুলোকে বাক্সবাড়িতে আটকে দিলাম।”।
শর্মিলা একছুটে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। হাউহাউ করে কাঁদছে সে। যে শিঁকড়ের টানে একটুও ভয় পায়নি তারা পনেরো বছর পর নিজেদের দেশে ফিরতে সেখানেই এত অবহেলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তার ছেলেকে। শুধুমাত্র রিওর জন্ম বিদেশের মাটিতে বলে। এ কেমন বিচার! ভারতবর্ষের জন্য যদি দুঃখ হতে পারে, তখন যে দেশে একটা শৈশব বড় হয়েছে তাকে ভালবাসলে কেন এত বৈষম্য! না রিওকে শর্মিলা বোঝাবে সে ভুল নয়। ভুল তারা যারা তাকে বন্ধু করছে না। রিওকে বলবে সে, তার দেশ দুটোই। একটা জন্মসুত্রে অন্যটা অস্তিত্বে।
শর্মিলা ফিরে আসে ঘুমন্ত রিওর পাশে। ছেলেটা স্বপ্ন দেখে বিড়িবিড় করছে, “কান্ট্রি রোড, টেক মি হোম। টু দি প্লেস আই বিলং”॥
0 Comments