"রাত দশটা বেজে গেছে, এখনও রাধিকা বাড়ি ফিরল না। এ কেমন মেয়ে মানুষ করেছে তোর শাশুড়ি বাবু?" উচ্চস্বরে মায়ের চিৎকারে টনক নড়ল অভিরাজ এর, সত্যিই তো রাধিকা আজ বড্ড দেরী করছে, সাধারণত এত দেরি তো করেনা। চিন্তান্বিত মুখে উঠে এল খাবার ঘরে, মাথা নত করে মিনমিনে গলায় বলল, "মা অফিসে কাজের চাপ, হয়ত আটকে গেছে, আমি ফোন করেছিলাম, বলল ট্যাক্সি তে আছে, আসছে।" ছেলের মিথ্যা টা ধরতে সময় নিলনা নীলিমা, ঝাঁঝালো গলায় মৃন্ময় কে ঠেস মেরে বলে উঠল, "তখনই বলেছিলাম, বাপ মরা মেয়েটাকে দেখেই গলে যেওনা, একটু খোঁজ খবর নাও, তা নয় এককথায় ছেলের বিয়ে পাকা করে এল। এখন ঠেলা সামলাও।" গজগজ করতে করতে ঘরে চলে গেল নীলিমা। বাপ ছেলে চুপচাপ থাকাই ঠিক মনে করে বসে পড়ল।
সাড়ে দশটা বেজে গেছে, এখনও রাধিকার দেখা নেই। রাধিকার ফোনটাও বন্ধ, কি যে করে না মেয়েটা। এত রাত হয়ে গেল, এখনও আসার নাম নেই, দেরি হচ্ছে একটা ফোন করেও তো লোকে জানায়, তা নয়। রাগে গজগজ করতে করতে সবে আর একবার ফোন করতে যাবে অভি, এমন সময় রাত দুপুরে পাখির ডাক ওয়ালা কলিঙবেলটা বেজে উঠল। দরজা খুলে রাধিকা ঢোকার আগেই শাশুড়ি মায়ের রোষানলে পড়তে হল তাকে। "এই তোমার আসার সময় বৌমা, কতবার বলেছি না আমাদের এই পাড়াটা বর্ধিষ্ণু পাড়া, এখানে কোনো বাড়ির মেয়ে এত রাত অবধি বাড়ির বাইরে থাকেনা।" আর কিছু বলার আগেই নীলিমার হাত দুটি ধরে শান্ত গলায় রাধিকা বলে, "খুব ভুল হয়ে গেছে মা, আর হবেনা কোনোদিন, মাসের শেষ তো, তাই একাউন্টস ডিপার্টমেন্টে খুব কাজের চাপ, কাল থেকে ঠিক সময়ে বাড়ি চলে আসব।" এই বলে ঘরে চলে যায় রাধিকা, নীলিমা ও আর কিছু বলতে পারেন না মাত্র তিন মাসের পুরোনো এই লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটাকে। সত্যিই মেয়েটার কথায় যেন জাদু আছে, তিনি এত রাগারাগি করেন আজ অবধি মুখের ওপর উত্তর দেয়নি রাধিকা। একেক সময় মনে হয় সবটাই ভড়ং, হয়তো পুরোটাই ভালোমানুষির মুখোশ।
স্নানে গেছে রাধিকা, হঠাৎই তার ফোনে এক অচেনা নম্বর থেকে ফোন। আগুপিছু না ভেবেই ফোনটা তোলে অভিরাজ, ওপাশ থেকে ভেসে আসে গম্ভীর গলা, "কাজ হয়ে গেছে ম্যাডাম, বাকিটা আপনি দেখে নেবেন।" কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই স্নান সেরে আসে রাধিকা, ফোনটা কেড়ে নেয় অভিরাজের হাত থেকে, রাগত অথচ চাপা গলায় বলে, "আমার ফোনে আর কোনোদিন হাত দেবেনা, ফোনটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত জিনিস, আমার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ আমি একদম পছন্দ করিনা।" ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায় বারান্দায়। ধপ করে বসে পড়ে অভিরাজ, এ কোন রাধিকা কে দেখছে সে, শান্তশিষ্ট নম্র স্বভাবের রাধিকা, তার ফোনে এইরকম অদ্ভুত ফোনের মানে কি? তাহলে কি সত্যিই আদতে যা দেখা যায় রাধিকা তা নয়? কিন্তু অভিরাজ ভাবতেও পারেনা আর কি কি অপেক্ষা করছে তার জন্যে। সেদিনের মতো নীরসভাবেই দিন শেষ হয়, যদিও রাধিকার মতে তার অফিসের জুনিয়র ফোন করেছিল এটা জানাতে যে তার একাউন্টে র কাজ হয়ে গেছে। কথাটা মেনে নিলেও কোথাও একটা খটকা রয়েই যায় অভিরাজের মনে।
এরপর কেটে গেছে আরো দুমাস, রাধিকার কোনো কিছু অস্বাভাবিক ব্যবহার চোখে পড়েনি কারুর, সেদিনের ঘটনাও আবছা হয়ে গেছে অভিরাজের মনে। আজ রাধিকার বাড়ি নিমন্ত্রণ ছিল জামাই ষষ্ঠীর - সকালে দুজনের ই অফিস ছিল তাই রাতে অফিসফেরত ডিনার সেড়ে বাড়ি ফিরবে। দুর্ভাগ্যবশত আজই অভিরাজের বাইকটা গ্যারেজে দিতে হয়েছে ইঞ্জিনের কিছু সমস্যার জন্য। উঠি উঠি করেও বেশ দেরি করে ফেলেছে তারা বেরোতে। এখন ই প্রায় দশটা বাজে, গড়িয়া থেকে শ্যামবাজার পৌঁছতে এগারোটা বাজবে। এতরাতে মেট্রোর ঝুঁকি নেবার ইচ্ছে ছিলনা অভিরাজের, কিন্তু রাধিকার জোরাজুরি তে মানতেই হয়, তার ওপর খরচের কথাটাও মাথায় রেখে রাজি হয়ে যায়। মেট্রো তে ফিরবে বলে রাধিকা কে বলে তার পরনের গয়নাগাটি মায়ের কাছে খুলে আসতে।
অভিরাজের বাড়িটা শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে একটু ভেতরে। মেট্রো স্টেশনে যখন নামে প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। রাস্তাঘাট জনমানবশূন্য না হলেও খুব একটা লোক নেই। পাড়ার গলিটায় ঢুকতেই একটা কড়া মদের গন্ধ। এই প্রথমবার রাস্তায় রাধিকার হাতটা শক্ত করে ধরল অভিরাজ, বলল কোনো দিকে তাকাবে না, সোজা চলে এসো। ততক্ষণে জনমানবহীন ভাঙা বাড়িটার রকে যেসব ছেলেগুলো আড্ডা মারছিল তারা টোন টিটকিরি করতে শুরু করেছে।
দুজনের চোখেমুখে ভয়, রাধিকা পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। অভিরাজ ও নিপাট ভালোমানুষ, মায়ের বাধ্য ছেলে সে, স্কুল কলেজেও কখনো মারামারি করেনি। রাগ হলেও এতগুলো অসভ্য নেশাগ্রস্ত লোকের সাথে লড়াই করা তার দ্বারা সম্ভব নয়। মাথা নীচু করে পা চালায় দুজনে। হঠাৎই রাধিকার আঁচলে একটা টান পড়ে। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকায় অভিরাজ। "ওইভাবে দেখছি কাকে?" বলে একটা সজোরে চড় পড়ে অভিরাজের গালে, টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় সে। চশমা টা কোথায় যেন ছিটকে পড়ে, মাইনাস পাওয়ারের এই চশমা ছাড়া রীতি মতো অন্ধ অভিরাজ। অন্ধকারে হাতড়াতে থাকে। কিন্তু চশমা টা খুঁজে পেয়ে ঝাপসা দৃষ্টি তে যে দৃশ্য সে দেখে তার জন্য একদমই তৈরি ছিলনা - শাড়ির আঁচল টা কোমরে পেঁচানো, তার নীচে উঁকি মারছে কালো জিনস, রাধিকার একেকটা লাথিতেই ছিটকে পড়ছে মাতালগুলো। যে ছেলেটা আঁচল টেনেছিল সে হাতটা ধরে তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়, বাকিগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। সবকটা কে শয্যাশায়ী করে কাকে যেন একটা ফোন করল রাধিকা, তারপর এগিয়ে এল অভিরাজের দিকে, হাত টা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "চলো, অনেক দেরি হয়ে গেছে।" অভিরাজ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যন্ত্রচালিতের মতো রাধিকার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়াল। "এইসব কথা বাড়িতে বলতে যেও না প্লিজ। আমি জানি অনেক প্রশ্ন তোমার মনে, কিন্তু আজ নয়। ঠিক সময় সবটাই জানতে পারবে।"
বাড়ি ফিরে অনেক প্রশ্নর সম্মুখীন হতে হল দুজনকেই, কিন্তু বাহানা করে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হল তারা। রাতে ঘরে এসে অভিরাজ ভেবেছিল আজ সত্যিটা জানতেই হবে, কিন্তু দেখল রাধিকা ঘুমিয়ে পড়েছে। কেমন যেন মায়া হল মুখটা দেখে। কিছুতেই মেলাতে পারল না নিজের চোখে দেখা ওই মারকুটে মেয়েটার সাথে এই নিষ্পাপ মুখটা। শুতে আসার সময় দেখল রাধিকার ফোনটা বাজছে, কোনো একটা প্রাইভেট নম্বর থেকে ফোন। হাজার ইচ্ছে হলেও আগেরদিনের কথা ভেবে ফোনে হাত দিলনা সে। অনেক রাত অবধি জেগে রইল অভিরাজ, রাধিকা কি কোনো খারাপ কাজের সঙ্গে যুক্ত, কে ফোন করে তাকে, আর এইরকম মারপ্যাঁচ ই বা শিখল কোথায় রাধিকা। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে, ঘুম ভাঙল মায়ের চেঁচামেচি তে। "তখনই বলেছিলাম বাপ মরা মেয়ে, ভালো হবে না, এখন বুঝে দেখো। সাতসকালে মহারানী কোন অভিসার থেকে এই পোশাকে ফিরছেন কে জানে, ছি ছি, লজ্জ্বায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার।" অভিরাজ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখল রাধিকা ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে, পরনে নীল জিন্স আর কালো সার্ট, হাতাটা গোটানো, চুলটা টেনে বাঁধা একটা পনিটেল করে, মুখে চোখে যেন একটা অদ্ভুত দীপ্তি।
ঘড়িতে বাজে ভোর ছটা, বাইরে সবে সকাল হয়েছে।অভিরাজ অবাক হয়ে যায় যে এতো ভোরে কোথায় বেড়িয়েছিল রাধিকা। কিছু বলার আগেই চেঁচিয়ে উঠলেন নীলিমা, "এই অসভ্যের মতো পোশাকে কোথায় গেছিলে তুমি? এক্ষুনি যাও তৈরি হয়ে নাও, বাবু আজ ই তোমায় বাপের বাড়ি রেখে তারপর অফিস যাবে। যে নাগরের সাথে বেড়িয়েছিলে তার গলাতেই ঝুলে পড়ো, বাবু তোমায় ডিভোর্স দিয়ে দেবে। এই সমস্ত নোংরামো আমার বাড়িতে চলবেনা।" এই বলে ঘরে ঢুকে গেলেন তিনি। রাধিকা নিরুত্তাপ, চুপচাপ ঘরে ঢুকে মুখ হাত ধুতে চলে গেল সে। অভিরাজ হতভম্ব হয়ে গেছে, তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, তাহলে কি সত্যিই রাধিকা কোনো খারাপ সঙ্গে যুক্ত। মৃন্ময় ও গোঁজ হয়ে বসে আছেন।
সাড়ে সাতটা বাজতে যায়, এখনো ফ্রেস হয়ে আসেনি রাধিকা। বাইরের কলিঙ বেলের শব্দ, খবরের কাগজটা ছুঁড়ে দিয়ে ছেলেটা।অভ্যাস মতোই মৃন্ময় কাগজটা তুলে পড়তে পড়তে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, "বাবু নীলিমা শিগগিরই এসো, দেখে যাও কি লিখেছে।" অভিরাজ কাগজটা নিয়েই আঁতকে উঠল, নীলিমার অবস্থাও তথৈবচ। এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল রাধিকা।
অভিরাজ একবার রাধিকা কে দেখে আর একবার খবরের কাগজ দেখে। খবরের কাগজের প্রথম পাতার খবর, "সিবিআই অফিসার রাধিকা দাসগুপ্তের বিশেষ তত্ত্বাবধানে ধরা পড়ল কলকাতার এক নারী পাচার চক্র।" রাধিকা ই বলে এবারে, "আসলে আমার বাবা ছিলেন সিবিআই অফিসার, এরম একটা কেসে ই আততায়ীর গুলিতে বাবা প্রাণ হারান। ছোটো থেকেই এই স্বপ্ন নিয়েই আমি বড় হয়েছি। কিন্তু আমার কাজের স্বার্থেই এই পরিচয়টা আমায় গোপন করতে হয়েছে।"
"ওই জন্যেই কাল ওতো সহজে ওই মাতাল গুলো কে পিটিয়ে সায়েস্তা করে দিলে কাল, " আমতা আমতা করে বলে অভিরাজ। "আমি ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট" বলে হেসে ফেলে রাধিকা।
"পারলে আমায় মাফ করে দিও রাধিকা, আমি খুব খারাপ কিছু কথা তোমায় বলে ফেলেছি, " হাত জোর করে বলে নীলিমা। "এমা একি করছ মা, আমি কিছু মনে রাখিনি," মিষ্টি হেসে বলে রাধিকা। এমন সময় ফোন বেজে ওঠে তার, মুহুর্তের মধ্যে সরল সাদাসিধে মুখটা হয়ে ওঠে বুদ্ধিদীপ্ত কঠিন। ফোনে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় সে, আর তার যাওয়ার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে পরিবারের বাকি তিন সদস্য নারীর এক ই অঙ্গে এত রূপ, কখনো মা পার্বতী তো কখনো দশভূজা দূর্গা তো কখনো আবার রণচণ্ডিনী রূপে মহাকালী - রাধিকা যেন সত্যিই এই সব রূপের প্রতিরূপ।
লেখিকা অমৃতা বিশ্বাস
কালকাজি, নিউ দিল্লী, ভারত