রাতের পৃথিবী দেখার মজাই আলাদা। কোনো এক কবি বলে গেছেন, 'পৃথিবীর যদি আসল সৌন্দর্য দেখতে হয় তবে রাতের পৃথিবী দেখো।'
আমি অবশ্য রাতের পৃথিবী দেখার সাথে সাথে কোন বাড়ির দরজায় কোন তালা লেগে আছে সেটাও দেখি। আর এরকম আমি করে আসছি বিগত পাঁচ বছর ধরে। আগে আমি কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম তবে ওখানে এখন পুলিশের টহল অনেক বেশি তাই আমার পছন্দ এখন মফঃস্বলের রাস্তা। দেখতে শুনতে বেশ ভালো বলে হঠাৎ পুলিশের সামনে পড়লে তেমন অসুবিধা হয় না। কথায় আছে, যে চোর তার শরীর লুকিয়ে রাখে সমাজের থেকে সে সবচেয়ে বেশি সাফল্য লাভ করে। আমিও এই সাফল্য লাভ করে আসছি বিগত পাঁচ বছর ধরে।
শহুরে ফ্ল্যাটবাড়ি আমার ভালো লাগেনা। সেখানে প্রধান গেট থেকে শুরু করে শিরা, উপশিরার মতো দরজা। তার উপর ইন্টারলক্ সিস্টেম। এর থেকে কথিত কলকাতার বাইরের বাড়িগুলো ভাল। কারণ এখানে বাড়ির দরজায় তালা ঝোলে। বাড়ির মালিক রাতে দরজায় তালা দিয়ে ভাবে সে অত্যন্ত নিরাপদ। কারণ তালা কোম্পানিগুলো বলে থাকে তাদের তালা হল ' ইউনিভার্সাল কি 'বিশিষ্ট। অর্থাৎ সেই তালা খোলার জন্য যে চাবি তা এই পৃথিবী তথা মহাবিশ্বে একটাই তৈরী হয়েছে। কিন্তু বেচারারা জানে না যে আমার মতো ডাকাতরা চাবি নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না। আমরা যেটা করি সেটা হল, তালার হাতলে অ্যাসিড ফেলে তা গলিয়ে দিই। একে বলে বাইপাস মেথড। এই বিদ্যা আমায় শিখিয়েছিল প্রেডিসেন্সি জেলে আমার উস্তাদ রাখিবুল খাঁ। এই অ্যাসিডের নাম কি আমি জানি না। তবে এই অ্যাসিড তালার হাতলে পড়লে মাখনের মতো তালা গলে যায়। যদিও এই অ্যাসিডের নাম জানার অনেক চেষ্টাই আমি করেছিলাম।
পার্কসার্কাসের রেললাইনের ঝুপড়িতে একডাকে চেনে আসিফ কালিককে অ্যাসিড দাদা বলে। এর কারণ তার কাছেই একমাত্র এই অ্যাসিড পাওয়া যায়। যার দাম এক লিটার আড়াই হাজার টাকা। আসিফ ভাইকে প্রশ্ন করেছিলাম, তবে সে উত্তর দয়েছিল, ভাইজান, নাম জানি না। খিদিরপুর ডকে মাল আসে। আমি নিয়ে আসি। আমিও এর নাম কোনোদিন জানতে চাইনি। তবে এখন এই অ্যাসিডের কাস্টমার অনেক।
এরপর থেকে আমি আসিফের কাছে যতবার গেছি সে কখনও নাইট্রিক, কখনও সালফিউরিক, আবার একবার বললো এই অ্যাসিড আমেরিকার এক বৈজ্ঞানিক গুপ্তভাবে তৈরী করেছে। তার নাম অনুসারে এই অ্যাসিডের নাম আর্মাড। মানুষ যখন অন্তরীক্ষে যায় রকেটে চেপে তখন তাদের এই অ্যাসিড দেওয়া হয়। প্রয়োজনে তারা ইস্পাতের মতো ধাতুও এই অ্যাসিড দিয়ে গলিয়ে দিতে পারে।
আমি আজ ঘুরলাম বাগুইহাটির অশ্বিনীনগর অঞ্চলে। বেশ কয়েকটি বাড়ি চিহ্নিত করে রাখলাম। বেশিরভাগ বাড়িতেই একটা করে তালা ঝুলছে। কিন্তু এরপর আমার এই বাড়িগুলোতে নজর রাখতে হবে। বাড়িতে কজন থাকে। কুকুর আছে কি না, বাড়ির লোক ব্যবসা করে নাকি চাকরি। এরপর আমায় আমার গ্রুপকে খবর দিতে হবে। আমি প্রতিটি অপরেশনে নতুন ছেলেদের নিয়ে কাজ করি। আমার গ্রুপে থাকে আমি ছাড়া আর দুজন। আমি ছেলে তুলি চাঁদনি বা পার্কসার্কাস থেকে। গ্রুপে বেশি ছেলে নিলে মুস্কিল। এতে সমস্যা বাড়ে। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্টের মতো ব্যাপার।
আজ রাতের মতো আমার কাজ শেষ। এখন ভোর ৫টা বাজে। আমি বাসে করে এসে নামলাম এয়ারপোর্টের সামনের একটা মাঠে। এখানে হরির চায়ের দোকানে দুকাপ চা খাবো। তারপর সোজা বাড়ি।
হরির চায়ের দোকানে সারারাত চা পাওয়া যায়। আমায় দেখা মাত্র হরি হাসতে হাসতে বললো, দাদার আজ মনে হয় অনেক দেরি হয়ে গেল। অফিসে কাজ ছিল বুঝি!
আমি হ্যাঁসূচক মাথা নাড়িয়ে হরির বেঞ্চিতে বসে চা খেতে লাগলাম।
কিছু সময়ের পর দেখলাম এসটি মেয়ে একটি বড় ট্রলি ব্যাগ নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি কিছু বোঝার আগেই বললো, আমায় একটা সাহায্য করবেন? বেশ কিছুক্ষণ ধরে হাত দেখাচ্ছি একটাও ট্যাক্সি দাঁড়াচ্ছে না। আমায় একটা ট্যাক্সি ঠিক করে দেবেন?
আমি উদাসভাবে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম, কোথায় যাবেন?
মেয়েটি বললো, এসপ্ল্যানেড। পিয়ারলেস হোটেলে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। হাত দেখাতেই একটা হলুদ ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে।
মেয়েটির মুখ দেখে মনো হলো সে কিছুটা অবাক হয়ে গেছে। বিড়বিড় করে সে বললো, অদ্ভুদ ব্যাপার তো !
দরজা খুলে ট্যাক্সিতে ব্যাগ তুলে মেয়েটি বললো, ইয়ে মানে আপনাকে আমি লিফ্ট দিতে পারলে খুশি হবো।
আমি চা শেষ করে বললাম, আমার এখন বিশেষ কাজ নেই। চলুন আপনার সাথেই যাওয়া যাক। চাঁদনিতে আমার একজনের বাড়িতে যাওয়ার আছে।
দুই
আমরা এখন ট্যাক্সিতে। আমার পাশে সেই মেয়েটি বসে আছে। মেয়েটির বয়স আঠাশ থেকে তিরিশের মধ্যে। গায়ের রঙ নদীর মতো স্বচ্ছ। কোঁকড়ানো চুল, পরনে টি শার্ট আর জিন্স। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি বেশ চটপটে। কিন্তু মেয়েটা একটু ভাবুক প্রকৃতির। ট্যাক্সিতে ওঠার পর প্রায় ৫ মিনিট কেটে গেছে সে একটাও কথা বলেনি। হঠাৎ সে নিজের চিন্তার জগৎ থেকে উঠে এসে বলল, মাফ করবেন, আমি মাঝে মাঝে একটু চুপচাপ থাকি।
আমি বললাম, এতে মাফ দাওয়ার কিছু হয়নি; আমিও মাঝে মাঝে চুপচাপ থাকতে পছন্দ করি। নিজেকে মানুষ কোনো গভীর চিন্তার মধ্যে রাখলে চুপচাপ হয়ে যায়।
মেয়েটি বলল, অদ্ভুদ ব্যাপার, আমি সত্যিই একট বিষয় নিয়ে গম্ভীর চিন্তায় ছিলাম।
- কি ব্যাপার?
- সেটি পরে বলবো। আপনি এত ভোরে কি অফিস যাচ্ছেন না ফিরছেন?
- আমি ফিরছি।
- কিছু মনে না করলে আমি কি জানতে পারি আপনি কি করেন? কোনো অসুবিধা থাকলে বলতে হবে না।
আমি মৃদু হেসে জবাব দিলাম, আমি পার্ট টাইমে একটা কাজ করি। নাইট টিউটি।
মেয়েটি বলল, দেখুন কান্ড, এতক্ষন হয়ে গেল আমার নামটাই আপনাকে বলা হয়নি। আমার নাম তিতলী। আপনার নাম কি?
- আমার নাম শঙ্কর, তবে আমায় অনেকে শঙ্কু বলেও ডাকে।
- শঙ্কু নামটাই ভাল লাগল। যাইহোক, আপনাকে আমি আমার সম্বন্ধে কিছু বলি। আমার আরও একটি সাহায্যের দরকার। মনে হচ্ছে আপনি আমায় সেই সাহায্যটাও করতে পারবেন।
আমি নিজেকে ট্যাক্সির সিটে হেলিয়ে দিয়ে হাই তুলতে তুলতে বললাম, বলুন।
তিতলী বলে চলল, পাঁচ বছর বয়সে আমার মা মারা যায়। তারপর আমার বাবা আমায় এখান থেকে নিয়ে ইংল্যান্ড চলে যায়। আমি ওখান থেকেই পড়াশুনো করি। বর্তমানে আমি পদার্থবিদ্যায় Ph. D করেছি।
আমি কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকালাম তিতলীর দিকে। ভাবলাম, এত সুন্দর মেয়ে পদাথবিদ্যা নিয়ে কেন পড়াশুনা করলো। একে তো সাহিত্য নিয়ে পড়া উচিত। পদার্থবিদ্যা বা অংকের মানুষগুলো হবে চোয়ার ভাঙা, রোগা-প্যাটকা, চোখে হাই পাওয়ার চশমা। কোনো দিক থেকেই এই মেয়েকে পদার্থবিদ্যার মানুষ বলে মানাচ্ছে না।
তিতলী আমায় বলল, আমি কলকাতায় এসেছি একটি বই লিখতে। পদার্থবিদ্যার পাশাপাশি আমি লেখালেখিও করি। আমার বহু লেখা লন্ডনের পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। যে বইটি আমি এবার লিখবো আমি তার নাম দিয়েছি কলকাতা এক মায়াবী নগরি। নামটা কেমন লাগল আপনার?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, বেশ সুন্দর হয়েছে। কি সাহায্য দরকার সেটা বলুন।
তিতলী বললো, হ্যাঁ, এবার সেটাই বলবো। কলকাতায় আমার জন্ম হলেও এই শহরের আমি কিছুই চিনি না। আর আমার বই লেখার জন্য আমায় এই শহর ঘুরে দেখতে হবে। এই শহরের আনাচে কানাচে কি ঘটছে তা জানতে হবে আর তাই আমার একজন গাইড দরকার। আমি তাকে সপ্তাহে ১০০ ডলার দেবো। এবার আপনি কি আমায় একজন গাইড জোগাড় করে দিতে পারবেন?
আমি পকেট থেকে একটা সিগারেট-এর প্যাকেট বের করলাম। তিতলী বললো, এখন সিগারেট খাবেন না। আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন।
আমি সিগারেটের প্যাকেট হাতের মধ্যে নাচাতে নাচাতে বললাম, ১০০ ডলার সপ্তাহে খারাপ অফার না। চাইলে আমি আপনার গাইড হতে প্রস্তুত।
ভোরের আলার মতো মলিন হাসি দিয়ে তিতলী বললো, এতো আপনি আমার মনের কথা বললেন। আমিও এটাই ভাবছিলাম। আপনিই তা হলে আমার গাইড হবেন। তবে একটা কথা আরও বলার আছে।
আমি বললাম, আবার কি কথা! সিগারেট ধরাই এবার?
বিচলিত হয়ে তিতলী জবাব দিলো, না, আমি যখন বলবো তখন ধরাবেন। সিগারেটের ধোঁয়া আমায় গভীর চিন্তা করতে বাধ্য করে। আমি আবার চুপচাপ হয়ে যাবো। এবার শুনুন যে কথাটা বলার ছিল তা হলো, আপনার শনি-রবি ছুটি থাকবে। এবার প্রশ্ন করুন কেন?
- কেন?
- কারণ, ঐ দুটি দিন আমি কলকাতার বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে ঘুরবো। আমি সেসব জায়গায় থাকা মানুষগুলোকে অবজার্ভ করতে চাই। মানুষ যখন ভক্তি ভরে পুজো করে তখন তাদেরকে অবজার্ভ করার মধ্যে আমি আনন্দ খুঁজে পাই। আপনি যদি এসবের ক্ষেত্রে রাজি হয়ে থাকেন তাহলে জানান।
- আমি রাজি। এবার সিগারেট ধরাই?
- তাহলে আজ থেকেই আপনি কাজে নিযুক্ত হলেন। কোনোদিন কাজে কামাই করলে সেদিনের টাকা পাবেন না। আমার হাতে সত্তর দিন সময় আছে। তারপর আমার ভিসা শেষ হয়ে যাবে। তাই আমার কাছে প্রতিটি দিন খুব ইম্পরটেন্ট। এবার আপনি সিগারেট ধরাতে পারেন।
আমার সিগারেট ধরানো হলো না। কারণ হোটেল পিয়ারলেস এসে গেছে। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। তিতলী গাড়ি থেকে নেমে সোজা হোটেলের ভিতরে ঢুকে যায়। আমিও তার পিছন পিছন হোটেলে ঢুকলাম। পিয়ারলেস হোটেলের ৮তলার ৪০৫ নম্বর রুমের সামনে গিয়ে তিতলী বললো, আপনি এখানে দাঁড়ান। আপনাকে আমার আরও কিছু বলার আছে। তিতলী ঘরে ঢুকে গেল। মিনিট পাঁচেক পর দরজা খুলে আমায় ভিতরে আসতে বললো। আমি ৪০৫ নম্বর রুমে ঢুকে একটি সোফায় বসলাম। তিতলীকে দেখলাম আমার মুখোমুখি বসতে। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আপনাকে কাজে নেওয়া তো আমার হয়ে গেছে কিন্তু কাজ করার আগে আমার কিছু প্রশ্ন আছে।
আমি বললাম, বলুন।
- আপনার আমাকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই?
- নাহ্। মানুষকে নিয়ে আমি বেশি উৎসাহ দেখাই না। তবে একটি প্রশ্ন করতে চাই, ছোটবেলা থেকে বিদেশে থেকেও এত ভালো বাংলা কিভাবে বলেন?
- আপনার প্রশ্ন শুনে ভালো লাগলো। আপনি হয়ত জানেন না অবান্তর প্রশ্নের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সৃষ্টির ইতিহাস। আমার বাবা লন্ডনে যাওয়ার পরেও আমাদের বাড়িতে কঠোর নিয়ম করেছিলেন যে বাড়িতে সবাইকে বাংলায় কথা বলতে হবে। তাই আমি এবং আমার সৎ মা বাড়িতে বাংলায় কথা বলতাম। আপনাকে জানানো হয়নি যে আমার বাবা ইংল্যান্ডে গিয়ে দ্বিতীয়বার নিয়ে করেছিলেন, আমি জানি না আপনাকে আমি কেন এতসব বলছি, তবে কেন জানি আমার বলতে খুব ভালো লাগছে। আপনার আর কোনো প্রশ্ন আছে? থাকলে করতে পারেন।
- না এখন আর কোনো প্রশ্ন নেই। আমি কি তবে কাজে নিযুক্ত হলাম?
- ১০০% কাজে নিযুক্ত হলেন। আশাকরি আমার গাইড হিসেবে কাজ করে আপনার ভালো অভিজ্ঞতাই হবে। আমি এখন স্নান করে ঘুমাতে যাবো। আপনি আজ বিকেল ৪টে নাগাদ চলে আসবেন। আমরা তারপর বেরোবো।
আমি 'হ্যাঁ' বলে হোটেল থেকে বেরোলাম। সকাল সাতটা বাজে। এরপর চাঁদনি ঘুরে যেতে হবে। চোরাগলি বলে বিখ্যাত এলাকায় আসিফ বলে আমার এক পুরনো সঙ্গী আছে। আজ রাতে অশ্বিনীনগরে আমার দেখা পছন্দের বাড়িগুলো নিয়ে তার সাথে আলোচনা দরকার। ডাকাতির প্রাথমিক প্ল্যান আসিফের থেকে কেউ ভালো করতে পারে না। তারপর বাড়ি ফিরবো।
(ক্রমশ)
গল্পকার কৌশিক দে
শরৎ বোস রোড, কলকাতা