হৃদস্পন্দন

  • Home


  • Download

  • Social

  • Feature


বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের কথারা 

অন্ধকারের সাথে গল্প করতে করতে কখনো
আটচালা হয়ে উঠি
দূরে সরে যায় বিশ্বাসঘাতক অবয়ব
প্রতিবেশী মুখগুলো পাশে থাকবে বলেও, 
বয়ান পালটে হঠাৎ মুখোশ পরে নেয়
নি:সঙ্গতার পাতায় অশ্রু জমতে জমতে একদিন হয়ে যায় স্ফটিক

আত্মকথনে রত হতে হতে আমি বটগাছ হয়ে উঠি

কবি অদ্রিজা মণ্ডল 
আলিশা, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ 









হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন নিবেদিত 'জমকালো রবিবার ৩' সংখ্যার লেখকসূচি:
 


কবিতা: সিদ্ধার্থ সিংহ, অনুপম দাশশর্মা, রবীন বসু, সূর্য মণ্ডল, মহম্মদ সামিম, দেবার্ঘ সেন, সুধাংশুরঞ্জন সাহা, রুমা ঢ্যাং অধিকারী, অন্তরা দাঁ, অমর্ত্য দত্ত, তুলসীদাস ভট্টাচার্য, শুভ্রাশ্রী মাইতি, সাত্যকি, সমর সুর, বিশ্বজিৎ দাস, স্বপঞ্জয় চৌধুরী, নাসিম বুলবুল, সৌমিত্র শীল, সুকুমার হালদার, সঞ্জীব সেন, চিরঞ্জিৎ বৈরাগী, প্রনব রুদ্র, সুজিত কুমার মালিক , বর্ণজিৎ বর্মন, অনিন্দ্য পাল, সুনন্দ মণ্ডল, মীরা মুখোপাধ্যায়, বৈদূর্য্য সরকার, সূর্য দত্ত এবং তিয়াসা জানা 

গল্প: পুলককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সমাজ বসু, রিঙ্কি বোস সেন, ঋভু চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ বর, উত্তম সিংহ, নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী, অনামিকা দে রায়চৌধুরী, অদিতি ঘোষদস্তিদার এবং সোমা সাহা

মুক্তগদ্য: সোমনাথ বেনিয়া, অনিন্দ্য দত্ত,  দীপক বেরা, সুমিতা চক্রবর্তী এবং মোনালিসা নায়েক

প্রবন্ধ: শৌভিক চ্যাটার্জী, লক্ষ্মণ দাস ঠাকুরা এবং মধুমিতা রায় চৌধুরী মিত্র 



সম্পাদকীয়: 

"বিষণ্ণতা ও প্রিয় ঘুম" এই শীর্ষক নিয়ে সম্পাদকীয় লিখতে বসলে বিষণ্ণতা ও কবিতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । তবে একথা লিখলে আবার ঘুমের প্রতি সম্পূর্ণ অবিচার করা হয় । যেখানে কবিতা আসেনা সেখানে তো ঘুমই প্রেমিকা হয়ে ওঠে। 

আসলে আমাদের সব বিষণ্ণতাই তার ভিতরে এক গভীর শূন্যতাকে লুকিয়ে রাখে।শরীর থেকে সাবধানে খুলে রাখা শূন্যতাটুকু জুড়ে শুধু পড়ে থাকে অপেক্ষা আর অভাব।থার্মোমিটারে সেই শূন্যতাকে কখনই মাপা যায় না । শীতজন্ম নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পড়ন্ত ছায়ার পাশে একটা সময় নেমে আসে নীল ঘুম।দিগন্ত বিস্তৃত বিষণ্ণতা ও হেঁটে যায় সেই নিবিড় ঘুমের দিকে । বিষণ্ণতার আসকাড়া ভুলে কেঁদে ওঠা স্বরলিপিরা তখন দূরে কোথাও বেজে ওঠে বৈরাগীর একতারা হয়ে । আলতো করে চোখের পাতায় নেমে আসে সোহাগী ঘুম। 
আর পড়ন্ত রাতে বিষণ্ণতা মাখা শরীরে যখন আয়না জাগে,শীতঘুম ভেঙে চিঠি পাঠায় তখন অপেক্ষার শব্দেরা। 
আমরাও ফিরে আসি যে যার ব্যক্তিগত গদ্যের পাশে। প্রিয় ঘুমের মধ্যেই একটু একটু করে বিষণ্ণতা ডুবে যেতে থাকে। 
আদতে বিষাদের মধ্যেও ঘুমই শুধু মৌলিক আর বাকী সবটাই অভিনয়।

আসুন সবাই বিষণ্ণতা ভুলে থাকি । আমাদের যাপন জুড়ে শুধু বেঁচে থাকার গল্পেরা লেখা হোক । ভাল থাকুন সকলে, সুস্থ থাকুন । আমাদের হৃদয় জুড়ে শুধু সাহিত্য স্পন্দিত হোক । 

































যেভাবে দৃশ‍্য তৈরি করে অচেতন 
প্লাবন

বিষণ্ণতার রং কী। ধূসর, বাদামী না কী-
পাংশু কিংশুক?
জানা নেই। অথচ নুয়ে পড়ে ঘাড় গভীর আচ্ছন্নতায়।
ভাবি, তন্দ্রাচ্ছন্ন গহীনে যে অসীম প্রসারতা তা কী
ভেঙে দিতে পারে জৈব যাতনার সমগ্রকে।
ধুয়ে যায় বৃষ্টিজলে যে-সব দাক্ষিণ্যতা তাকে 
ফিরতে দেখিনি ষাঁড়াষাঁড়ি বানে।
মধ‍্যরাতে দূরে প‍্যাঁচার ডানা ঝাপটানোর শব্দ পেলে
কেন জানি চোখে ভেসে ওঠে জীবনানন্দর মেটে মুখ,
মুঠো মুঠো অবিশ্বাস উড়ন্ত পাখির পালক হয়ে 
তখন ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়।
ঠিক তৃতীয় প্রহরে মায়াময় হয়ে ওঠে নিশি
চেতনারহিত তন্দ্রার মৃদু সুর যেন বাঙময় তখন
কীভাবে যে ঘুম মুহূর্তে ভুলিয়ে দেয় যাপনের ক্লেদ
সব রং তখন মিলেমিশে হয় বিষন্নতার আহার।

কবি অনুপম দাশশর্মা
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত 









ঘুমগ্রন্থি এবং 

১/ 

এই সেই ঢেউখেলানো অফুরন্ত 
ঘুমের স্বপ্নবাসর

যেখানে পূর্ণিমার ধর্মসভায় জাদুকর নামেন সৈকতে
জলের প্যাঁচে মিশে যাওয়া তেষ্টার অনুঘটকে
যিনি বেড়ে দেন জ্যোৎস্নাগঙ্গা 

এমন স্বপ্নের হরফে বেজে ওঠে রাতের নূপুর
পাঠ করি বিষণ্ণ লোপাটের নামতা 


২/ 

অনর্থক তবু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে 
লিখে রাখে তালপাতার বিন্যাস। এ নিঃসঙ্গ পাণ্ডুলিপি

বিষণ্ণতা তো এক সজাগঘুমের গান। 
কুয়োর অলিখিত প্রেম যেন তাকে ঘিরেই জমা করে এসেছে দীর্ঘদিনের শ্যাওলা

এভাবে দিনের ক্রিয়াপদটি দুর্বলতম
শ্বাসে, অক্ষরে দাঁড়িয়ে মজে যাওয়া কাল 

ঘুমের আতর মাখা মেঘের গর্জন আমি কেবল শুনি 
এবং পা রাখি -- এক জঙ্গলকাব্যে 

কবি রুমা ঢ্যাং অধিকারী
সালকিয়া, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ 













বালিশ

বালিশের নীচে 
লুকিয়ে রাখি জলোচ্ছ্বাস 

বালিশের নীচে
লুকিয়ে রাখি অবাঞ্ছিত আদর  

এমনকি খুনের ইচ্ছে 

সে ক্ষমা শূন্য চোখে গ্রহণ করে আমার সকল অপরাধ।

কবি সূর্য মণ্ডল 
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত 












অর্পণ 

পুরনো অভ্যাসবশে সয়ে নিয়েছি বিষণ্ণ ঘুম
ফেলে আসা অপেক্ষার ক্ষণ, অশ্রুকথা
বালিশ থেকে মুছে গেছে কান্নার দাগ।
রাতের আকাশ বিছিয়ে রাখে নক্ষত্র-বিলাস
গহিন অরণ্যময় হয়ে আছে মৃত্যুহীন প্রহর
দুটি পেঁচা ডেকে ওঠে, ডুকরে ওঠে হৃদয়
শীতল হাওয়া বয়ে যায় চোখের পাতায়
বেদনায় রক্তক্ষরণ না হলে গাঢ় হয় না জীবন
তাই বারবার ফিরে গেছি বেদনার কাছে, অকারণ।


কবি মহম্মদ সামিম
পূর্ব খন্যান,খন্যান (ইটাচুনা), হুগলি












আচ্ছন্নতা

তন্ত্রের কেশ ধরে কে যেন টানছে
অধিকার বিলাসী ঘুমের ভেতর।
আমি হাত নেড়ে চলেছি আবেশে আবেশে..

তুমি বুঝি এসে বসলে ওষ্ঠের ওপর,
দূরতম অধর দ্বীপ, অসংখ্য টিলা..
একনিষ্ঠ আয়ু জ্বর।

আজকাল আর ঘুম হয় না জানো,
গলা দিয়ে শুধু নেমে যায় একটা
কালসর্প আচ্ছন্নতা..

অদূরেই ফোঁপায় কাঙাল বল্কলধারী
সোহিনী সম গাছ।
ভাবি কি নামে ডাকবো তাকে!! 

কবি দেবার্ঘ সেন
৫৯,চারাবাগান, শেওড়াফুলি, হুগলী














আলো আঁধারের খেয়া

একটা বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে দিয়া। রাত নেই, দিন নেই বই পড়ছে সে। কখনও পড়ার বই কখনও গল্পের বই। বাবা মারা যাবার পর থেকেই এমনটা হয়েছে দিয়ার। সারাক্ষণ মন খারাপ। এক বিষণ্ণতার অন্ধকারে সে যেন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে একটু একটু করে। বই ছাড়া কিছুই আর ভালো লাগে না দিয়ার। না বন্ধুদের ইয়ার্কি ঠাট্টা, না সিনেমা, না বাইরের জগত। সে যেন নিজেকে একটা একলা দ্বীপে বন্দী করে ফেলেছে।

কলেজের পড়া শেষ হয়েছে তার কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়নি সে। মা বলতে এলে মাকে বলেছে চাকরির জন্য চেষ্টা করবে সে। কী হবে মিছিমিছি একটা সার্টিফিকেট দিয়ে? কিন্তু চাকরির জন্যও পড়াশুনো করে না দিয়া। তার বদলে গল্পের বই পড়ে। মা এসে মাঝে মাঝে দাঁড়ায় ওর ঘরে। চারদিকে বইয়ের পাহাড়। তার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে দিয়া। মা চুলের জট ছাড়িয়ে দেয়।

''চোখ মুখের কী হাল করেছিস রে! চোখের তলায় কালি! গায়ে খড়ি উঠছে!''

দিয়া বাবার আরাম চেয়ারটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলে

''রাতে আমার ঘুম আসে না। মাঝে মাঝেই বাবাকে দেখতে পাই জানো!''

মা শুনে ঠোঁট টিপে কাঁদে।

''কই এতদিন পাশে থেকেছি, আমি তো একদিনের জন্যেও দেখলাম না তাকে!''

দিয়া মনে মনে হাসে। বাবা একেবারে তার নিজস্ব। বাবার স্বভাবও পেয়েছে সে। বাবাও এমন আরাম চেয়ারে বসে নানা রকমের বই পড়ত। রিটায়ারমেন্টের পর এটাই ছিল বাবার একমাত্র নেশা। দিয়ার দিকে ফিরে মা যাবার আগে বলে,

''রাতদিন শোক নিয়ে থাকতে নেই। কাল আমার এক বান্ধবীকে বাড়িতে খেতে ডেকেছি। বই মুখে বসে থাকিস না। লোকে নিন্দে করবে।''

সকালবেলা মা এসে ডাকল দিয়াকে। দিয়া ঘুমাচ্ছিল না, জেগেই ছিল। কী এক মনখারাপের অসুখ গ্রাস করেছে দিয়াকে। রাতদিন বাবার সঙ্গে আপন মনে কথা বলে।

''যা স্নান সেরে আমার বালুচরীটা পরে আয় সোনা মা! আমি চুল বেঁধে দেব।''

"কেন? আমি সাজতে টাজতে পারব না।''

''বেশ সাজিস না। তবে পেত্নীর মতও থাকিস না। এত সুন্দর চুল তোর! একটু আঁচড়ে নিস অন্তত!''

মায়ের বান্ধবী শীলা মাসি আর তার ছেলে দেবার্ক এসেছে। দিয়া জানে না, দেবার্ক আসলে দিয়াকে দেখতে এসেছে। মায়েরা সব পাকা কথা বলে রেখেছে আগেই। দেবার্ক দিয়ার পড়ার ঘরে এল। দরজার কাছ পর্যন্ত বইয়ের স্তুপ দেখে দেবার্ক অবাক। ওর চোখে মুগ্ধতা।

''এই এত বই আপনি পড়েন!''শুনে দিয়া অবজ্ঞার হাসি হাসল।

"বিভূতিভূষণের কোন উপন্যাস আপনার প্রিয়?''

"দৃষ্টিপ্রদীপ। পড়েছেন?''

"না ওটা পড়িনি। আমার প্রিয় বই আরণ্যক। জঙ্গল খুব ভালো লাগে।''

"বাবাও জঙ্গল ভালোবাসত।''

"তাই বুঝি?''

গল্প বেশ জমে ওঠে ওদের। দিয়া অবাক হয়, পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সে, কিন্তু দেবার্ক যেন সবার থেকে আলাদা! অনেকটা যেন তার বাবার মত! ওরা ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া করল।

রাতে শুতে এসেছে দিয়া। রোজ শুয়ে শুয়ে বই পড়ে দিয়া। আজ বই ভালো লাগল না। দেবার্ক যাবার সময় ওর হাতটা একবার ধরেছিল, সেই স্পর্শটা এখনও যেন হাতে লেগে আছে ওর। দিয়া চোখ বুজে দেবার্কর মুখটা মনে করতে লাগল। কখন বাবার মুখ আর দেবার্কর মুখটা এক হয়ে গেল। রাতে আর ওর সঙ্গে গল্প করতে বাবা এল না দিয়ার কাছে। দেবার্কর মুখটা মনে করতে করতে কখন সব মনখারাপ আর বিষণ্ণতা ভুলে গিয়ে দিয়া ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল।

  গল্পকার নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
                  মধ্যমগ্রাম, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ















মূষিক বৃত্তান্ত 

একটা ইঁদুর ঘরময় ছুটোছুটি করছে । এরপর একে একে আরও অনেকগুলো এসে জুটবে। রাত যত বাড়বে তত দলে ভারী হবে তারা।বেলাগাম ঔদ্ধত্য আর কাকে বলে! সারা রাত ধরে কী যে লাফালাফি দাপাদাপি! রোজই করে। অন্ধকার ঘরে আমার একচিলতে বিছানা। শুয়ে শুয়ে রোজই ওদের উপদ্রব সহ্য করতে হয়। অগত্যা! শরীরে তো এমন বল নেই যে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা ছাড়া ওদেরকে তাড়ানোর জন্যে উঠেপড়ে লাগব। ইঁদুরের দল আমাকে গ্রাহ্যির মধ্যেই আনে না। মনে করে একটা ফালতু। 
রাত আরও গভীর হলে একসময় দেওয়াল থেকে নেমে আসে সন্ধ্যা। প্রায়ই আসে। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করবে, "আজও কিছু খেলে না তো? "
"ইচ্ছে হয়নি। রোজ রোজ দু'মুঠো মুড়ি চিবিয়ে বালিশে মাথা পাততে হবে এমন হক আছে নাকি ? এরপর তো সারা রাত ধরে যত্ত হাবিজাবি চিন্তা !  দূর ! দিনরাত্তির সবই এক। জীবনভর ওই ইঁদুরগুলোর মতো এত লাফালাফি-দাপাদাপি করে কী এমন হল ! এখন আর হিসেব কষতেও পারি না।"
 "কী দরকার! তোমার হাতে তো কিছু নেই।"
  "কিন্ত তুমি এমন আদিখ্যেতা দেখাতে আসো কেন বলো তো? নিজের আখেরটা বেশ গুছিয়ে নিয়ে দিব্যি তো কেটে পড়লে !... আমার অবশ্য এখন দুঃখ-টুঃখ কিছু  নেই। আবার আনন্দও নেই। এমনকী, ক্ষোভ, অভিমান, খুশি, তৃপ্তি, অভিযোগ.... না, সেসবও নেই। এরকমই আরও অনেক 'নেই'গুলোকে একসঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে আমি রাত্তিরে একা ঘরে শুয়ে শুয়ে শুধু অন্ধকারে গোল গোল বৃত্ত আঁকি।"
        ওই ইঁদুরগুলো বড্ড জ্বালাচ্ছে। দুপুরের দিকে একবার পাড়ার দোকানে গেলাম। হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু না গেলে ইঁদুর-মারা বিষটা কে এনে দেবে ? সাধারণত সকালে কাউকে আমার মুখ দেখাতে চাই না। লোকে বলে, আমি অপয়া। এ-মুখখানা দেখলেই নাকি মহা অনর্থ। কেন ? না, ছেলেপুলের বাপ হতে পারিনি, তাই। আহা, কী রসিকতা একটা মানুষের সঙ্গে ! আড়াল-আবডালে এসব নিয়ে কত যে ঠাট্টা-তামাশা ! মরুকগে! 
      বিষের প্যাকেটটা মাথার কাছে রেখেছি। পাশে একবাটি জলও। দোকানের ছেলেটা বলেছে, "আট-দশটা দানা রয়েছে। একটা করে খেলেও একসঙ্গে গোটাকয়েক ছটফটিয়ে মরবে।"
      রাত ক্রমশ বাড়ছে। আমি তো ঘুমই না। পাল্লা দিয়ে  ইঁদুরের দলও জেগে থেকে তাদের রাজত্ব চালায়। ওরা এখন ঘরময় ছুটোছুটি করছে। একটা দানাতেই একটা খতম ! তাহলে সবকটা দানা একসঙ্গে পেটে পড়লে....? 
       ছটফটে ইঁদুরগুলো নিশ্চয়ই খুব দাপাদাপি করবে। শক্ত কাঠ হয়ে যাওয়া একটা মানুষের ঠাণ্ডা দেহটার ওপর দিয়ে দৌড়োদৌড়ি করলেও তখন এতটুকুও বাধা পাবে না। 

        লেখক পুলককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
মসাগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ 












    



আস্তরণের ঘুমবাসর

১.

বিষণ্ণতার আমন্ত্রণ হোক বা অন্ধ রাত্রির নৈবেদ্য
অথবা পালকলাগানো ঘুমবাসরের প্রিয় ঘুম,
সবটাই জটাজটিল ছেড়ে দুয়ার খুলে দাঁড়ায়
ঘুমিয়ে পড় বলে চুপি প্ররোচনায়,
কেন যে এই বাঁধা দিনেরা ঝিমোয়,অজানা...

২.

সর্বময় রাত্রিযাপন এখন ক্লান্তির কফিন
ছায়াস্তৃত শুধু একখানা মুখ দুরন্ত চোখে,
বারংবার অকৃপণ আকাশ হয়ে গোপনে ডাকে...
বিদ্যুত্ বাসরে মায়া ভিজে ভিজে হার মানে,
পরিপূর্ণ মুখে যে ক্ষীণায়ু ভালোলাগাটা কষ্ট ভুলে ছিল
বিষণ্ণতার মুক্ত লেখক সেখানে শব্দজাল খুলে
জানু পেতে নিজের হাতে ভিক্ষা করতে ভালোবাসে!

৩.

মনুমেন্ট স্লোগানে আবহমান হল্লা পাশে সরিয়ে
যেখানে দুপুরগুলো সুপুরি রঙে ঢাকা,
ইমানহীন বিজ্ঞাপনে চোখের কোনে মর্মবেলায়
এতিমের মতো যাওয়া আসার ছন্দ তাতে নেই
পক্ষাঘাতের ভিতরে ভিতরে গরিমা জমে গ্যাছে,
ঘুম দিয়ে না হয় সে দাহ ঢেকে নেওয়া হোক।

৪.

শরীর ঘেঁসড়েও আশ্রয়টুকুর জানবার কথা না
দশচক্রে বিগ্রহ যদি জন্মঠোঁট ছুঁয়ে,
পাথরে পাথরে খোদাই করে নিজের বিরুদ্ধে বলে
একদিন বিষণ্ণতা এসে দাঁড়ায় ভুল মানুষের ভাগ্যে
আসলে আচ্ছন্নতা আলো আঁধারের অসংলাপ,
এককথায় বলা যায় আপন মজ্জার ভিতর সমুদ্রভূক!

৫.

মৃতের চোখ ভরে দীর্ঘতম শেষ কথার আদলে
হেরিটেজ ট্রামের মতো ধ্বংসমুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
হলুদডোবানো নিরর্থের অলীক হাতে
কাতরতা ভেঙে,আয় ঘুম আয় বলে
আমরা কিন্তু ইতিমধ্যেই কত কলা শিখে নিয়েছি
আর যেটুকু বাকি থাকে,সময়ের হাতে থাক না,
আজ না হয় বিষণ্ণতা ও প্রিয় ঘুম নিয়েই কাটুক!

কবি নাসিম বুলবুল
সুলতানপুর, মিনাখাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা 



















কারা যেন আসে

মাঝেমাঝেই কারা যেন এসে রক্তে বিষ ঢেলে 
চলে যায়
আমি সারারাত ছটফট করি।
দেখি আমার বিছানার পাশে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী 
ভেসে যাচ্ছি ভেলার মতন।

মাঝেমাঝে কারা যেন এসে সারারাত মাথার ভিতর 
অদ্ভুত রকমের শব্দ করে ।
করোটি খুলে দেখি অস্পষ্ট পায়ের ছাপ 
সারারাত আমি পায়ের ছাপ দেখে আমার অতীত খুঁজি।

মাঝেমাঝে কারা যেন এসে
জোনাকির মত স্মৃতি উস্কে চলে যায়।
সারারাত আমি বিছানায় ছড়ানো কাঁটাগুলো এক এক করে সরাতে থাকি....

কবি সমর সুর
শ্যামা প্রসাদ পল্লী, রাণাঘাট, নদীয়া












সংগীতসুধা 

স্নান সেরে ঘরে ঢুকল বুলু। মা এখনো পাশবালিশ আঁকড়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। জানলা দিয়ে রোদ এসে ভেসে যাচ্ছে বিছানা। মায়ায় বুকটা ভরে গেলো কেমন যেন! পর্দাটা  টেনে দিয়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ।                                                 স্বপ্ন দেখছিলেন সুপ্রভা। ফুলের বাগান, নীল আকাশ, তিনি এক্কাদোক্কা খেলছেন! হঠাৎ ঢং ঢং করে কোথায় যেন বেল বেজে উঠলো!
চমকে জেগে সুপ্রভা জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন "কটা বেজে গেলো?"
তারপর ধড়মড় করে একেবারে উঠে বসে চারপাশটায় তাকালেন। খানিকক্ষণ বুঝতে সময় লাগলো।
" চেঁচিয়ে  উঠলে কেন মা? কি হয়েছে?"
মায়ের গলা পাশে রান্নাঘর অবধি গেছে। বুলু চা করা ফেলে প্রায় ছুটে এলো।  
" ভাবলাম বুঝি অ্যালার্ম বাজছে! চমকে উঠেছি। আসলে স্বপ্ন দেখছিলাম রে!"
" আহারে! তোমার অ্যালার্ম ফোবিয়া হয়েছে মা, এতো বছর না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে!"
ম্লান হাসলেন সুপ্রভা। চোখের কোণে কালি, গাল ঢুকে যাওয়া মাকে দেখে বুলুর আবার কষ্ট হলো।
কতদিন মানুষটা ভালো করে ঘুমোতে পারে নি।
বাবা চিরকালই রাগি, দাপুটে। বিছানায় পড়ে  গিয়ে আরো বাড়লো অত্যাচার। সারা রাত বিছানার পাশে চেয়ারে বসে থাকতে হত  সুপ্রভাকে। ঘন্টায় ঘন্টায় এটা ওটা হুকুম। না পেলে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল।
বুলু তখন কলেজে। বাবার টাকাপয়সা প্রায় সবটাই ওষুধ আর খাওয়াদাওয়ায় চলে যেত। মেয়েটার যাতে পড়ার ক্ষতি না হয় তার জন্যে সব কষ্ট নিজের ওপর নিয়েছিলেন সুপ্রভা।
কথা প্রায় বলতেনই না,সারাদিন চুপ করে শুধু অক্লান্ত পরিশ্রম।
একটাই লক্ষ্য বুলুকে মানুষ করা।
ভাল ছাত্রী ছিল বুলু বরাবরই। স্কলারশিপ জুটেছিল বিদেশ যাবার। রাজি ছিল না বুলু একেবারেই।মা'ই জোর করলো।
বছর পাঁচেক বুলু পিএইচডি শেষ করে কলেজে চাকরি করছে আমেরিকায়। সংসারের সব ভারই তুলে নিয়েছে।
বাবা চলে যাওয়ার খবর পেয়ে গেলো দেশে।
সুপ্রভা তো কবে থেকেই চুপ। স্বামী চলে যাবার পর এলো সারা শরীর জুড়ে অবসাদ।কাজ যতদিন ছিল টেনে যাচ্ছিলেন। কাজ নেই। এলো জীবন জুড়ে শুধু বিষণ্নতা। কিছুই ভালো লাগে না। বাইরে নিজেকে বের করতেও তীব্র অনীহা। সারাদিন ঘরে বসে থাকেন একা একা।
বুলু চেষ্টার ত্রুটি রাখলো না। সব ডাক্তারই  জানালেন এসবই  ডিপ ডিপ্রেশনের ফল। ঘুমই একমাত্র ওষুধ।
ওষুধ খেয়েও ঘুম আসেন না চোখে সুপ্রভার। সারারাত জেগে জেগে কেটে যায়।  আর মাঝে মঝেই চমকে চমকে ওঠান। কিসের যেন দেরি হয়ে গেলো!
অনেক কষ্টে মাকে রাজি করিয়ে বুলু মায়ের ভিসা করাল।
আজ সপ্তাদুয়েক হলো সুপ্রভাকে নিয়ে বুলু ফিরেছে কাজের জায়গায়!
নতুন জায়গায় এসে সুপ্রভার খুব যে একটা পরিবর্তন হলো না নয়। তও বুলু নিশ্চিন্ত মা কাছে আছে।
কাল বুলুর দুই কলিগ প্রফেসর এসেছিলেন বাড়িতে। বাঙালি।
সুপ্রভা  আসতে চাননি কাছে। বুলু জোর করেনি।
বীরেন বলে যে ভদ্রলোক এসেছিলেন তিনি ভারী ভালো গান করেন। তিনি যখন গাইছিলেন, ''নিদ্ নাহি আঁখিপাতে", হঠাৎ কে যেন গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠলো,
"আমিও একেলা, তুমিও একেলা!"
বীরেন আর বাকিরা চমকে উঠলেন, কিন্তু গান থামালেন না।
গান শেষহতে সবাই দৌড়ে পাশের ঘরে গিয়ে দেখলেন সুপ্রভা বিছানায় বসে আছেন আর দরদর করে চোখ দিয়ে পড়ছে জলের ধারা!
বুলুর মনে পড়লো দিদা বলেছিলো মায়ের  পছন্দের মধ্যে শুধু ছিল গান। অতুলপ্রসাদের গান গাইতেন রেডিওতে।
বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির দাপটে আর হয়ে ওঠেনি।
একটার পর একটা গান গেয়েগেছিলেন সুপ্রভা কাল।  বুলু অবাক হয়ে দেখেছিলো মায়ের মুখের প্রশান্তি।
ঘুম  এসেছিলো কাল অনেকদিনের পর। একেবারে রাত জুড়ে।  আজ ভোরে ভাঙলো সেই ঘুম।
বুলু গেয়ে উঠলো," মাগো, ঘুম এলো আঁখিপাতে!"

সাহিত্যিক অদিতি ঘোষদস্তিদার 
১৮৯ জনসন রোড, নিউ জার্সি, আমেরিকা





















বিষণ্ণতা ও প্রিয় ঘুম

মাথায় যেন পিন ফুটছে। বেসিনে টপ্ টপ করে জল পড়ছে। শেফালিদি আবার বাসন ধুয়ে ট্যাপটা বন্ধ করতে  ভুলে গেছে। বলে বলে আর পারা গেলনা, পিসিমা বলেন, মা বলে, অনল নিজেও কতবার বলেছে,তবু এ স্বভাবে শেফালিদির শোধরাবার নয়।এতদিন তাদের সংসারে আছে যে বেশি কিছু বলাও যায়না। সেই অনলের যখন  ছয় বছর বয়েস তখন এই বাড়িতে ঢুকেছে সে, আর আজ অনলেরই তিরিশ হলো। এখন  এই জল ঝরা যদি নিজে থেমে যায়, তবে রক্ষে, নয়ত সারারাত জ্বালাবে এই সর্বনেশে শব্দ।  এখন তো গিয়ে ট্যাপটাকে এঁটে দিয়ে আসাও যাবেনা, কারন রান্নাঘরে যেতে হলে তো পিসিমার ঘরের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে।
সবে ঘুমের ওষুধ খেয়ে  তিনি চোখ বুজেছেন, এখন  তাঁর  কোনো কারনে ঘুম ছুটে গেলে, সারারাত ছটফট করবেন,আর বিলাপ করবেন। অসহ্য লাগে অনলের,সব কিছুই অসহ্য লাগে তার,এই পিসিমার বিলাপ, মায়ের অর্থহীন বকরবকর, পাড়ার ছেলেদের  রাতে  বিকট গর্জনে বাইক চালানো, মাইকে পঞ্চাশ বার একই গান, হুলোদের ঝগড়া অথবা মেনীদের প্রতি তাদের চাঁদনী রাতে তারস্বরে প্রেম নিবেদন, দেবাশিষদের বাড়ির টিয়াটার হঠাৎ  রাধে রাধে বলে ফুকরে ওঠা, সব,সব।আচ্ছা,কোনো টিয়া রাতে চেঁচায়? এটা নিশ্চয়ই তারকাটা টিয়া।
রাতে বিরক্ত  করবার আরেক গুরুমশাই তো বাড়িতেই আছেন। অনলের সাক্ষাৎ বড়মামা শ্রী অজিত মিত্র। আরে হনুমান চল্লিশা বা শিবস্ত্রোত্র পড়তে হয় তো, নিজের ঘরে বসে মনে মনে পড়োনা, তা নয়, রাত এগারোটা বাজলো তো প্রাত্যহিক হেঁড়ে গলায় জয় হনুমান অথবা ওম নমঃ শিবায়, শিবায় শুরু হয়ে গেল। আবার অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে ওম জবাকুসুমসঙ্কাশন চালু হয়ে গেল। যা নারে ভাই, ভোর বেলা মর্নিওয়ার্কে গিয়ে  যতখুশী সূর্য বন্ধনা করনা, তা নয়, মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত  ঘটানো। নিজের  তো ইনসমনিয়া, তার সাথে গাউট থাকায় মর্নিওয়াকও বন্ধ। তাই ঘরে  বসে বাড়ির লোকের উপর এই অত্যাচার।  
বারোটার আগে  এই বাড়িতে ঘুম নামে না।বিছানায়  শুয়ে নাইট  ল্যাম্পের আলোয় কিছুক্ষন বই পড়বার পর সপ্তাহের সাত দিনে পাঁচ দিন অনলের খিদে পেয়ে যায়। ডঃঘোষ পরিস্কার বলেছিলেন, এটে তীব্র ডিপ্রেশন থেকে হোচ্ছে, না হলে সাড়ে দশটায় পেট ভরে খেয়ে সাড়ে বারোটায় আবার খিদে  পেতেই পারেনা
অনল জানে, এ খিদে  অন্য খিদে, দুই বছর হয়ে গেল জয়িতা বাচ্ছা হতে গিয়ে  দেওয়ালে ছবি হয়ে গেছে,বাচ্ছাটাও গেছে মার সাথেই।
অনল ভাবে, বেঁচে গেছে সে। যদি মাহারা বাচ্ছাটা বেঁচে থাকতো, তার দায়িত্ব নিতো কে? সে তো জেরবার হয়ে যেত।
একটা সরকারি ইস্কুলের ইতিহাস আর আঁকার মাস্টার সে। 
ইস্কুলে শেখানো ছাড়াও নিজের সিরিয়াস কাজ সে খুব মন দিয়েই করে।।বছরে একটি গ্রুপ  প্রদর্শনী এবং দুতিনটি ছবি বিক্রি তার বাঁধা।আর্টের বইগুলোর পাতা উল্টোতে উল্টোতে হতাশায় মন ভোরে যায় তার। কতরকমের কাজ হচ্ছে দেশে-বিদেশে,  তার বন্ধুরাও কত বিমূর্ত কাজ করে৷ কিন্তু সে আঁকতে গেলেই হয় ল্যান্ডস্কেপ নয় সিটিস্কেপ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও বিক্রি হয় সে সব তবুও  যথেষ্ঠ আধুনিক না হতে না পারার জন্য,  সে বন্ধুদের মাঝে মরমে মরে থাকে সবসময়।
মা আর পিসিমা বহুবার তাকে আবারও বিয়ে করতে বলেছেন। কিন্তু  তার মন অন্য ধাতুতে গড়া, জয়ির বিছানায় সে অন্য কাউকে ভাবতেই পারেনা আজও।  তবুও,মানুষের শরীর তো,শয্যা মাঝে মাঝে  তীব্র হয়ে ওঠে,তখন ল্যাপটপে নীল ছবি ছাড়া গতি নেই।সেটাও শব্দ বন্ধ করে দেখে সে, সেটার যদিও কোনো দরকারই নেই, কারন গভীর রাতে তার ঘরে কেইবা আসতে যাচ্ছে, তবু কেমন  যেন লজ্জা  করে অনলের।
উল্টোদিকের  বাড়িতে দীগিনবাবুর ষোলো বছরের ছেলে অভীক জড়বুদ্ধি। গহণ রাতে হঠাৎ বিশ্রী  গলায় গেয়ে ওঠে," আলোকের এই ঝরনা ধারায় ধুইয়ে দাও, দাও,দাও.." শুনতে খুব খারাপ লাগে, তবুও শুনতে শুনতে গলার কাছে কি যেন আটকে আসে। নিজের জন্ম না নেওয়া বাচ্ছাটার কথা মনে হয়। যদি এরকম  হোতো তারও ভাগ্যে!
আর একটা আওয়াজ, যেটা শুনলে গায়ের সব রোঁয়া দাঁড়িয়ে যায়,সেটা হলো কাঠের উপর ছুরির ঘষা। যেটা করে পাশের বাড়ির বুল্টু। মহাদেব জ্যেঠুর নাতি।রাত দেডটা দুটোর সময় তার কাঠের বেঞ্চে ছুরির কাজকর্ম শুরু হয়। খ্যাঁচ, খ্যাঁচ, ক্যাঁচ, ক্রঁচ...আগুন ছুটতে থাকে অনলের মাথায়।
তবে মহাদেব জ্যেঠু ও ইনসমনিয়ার রুগী। একটু পরেই শুরু হয় গোবেড়েন এর পালা।আশ্চর্য,  মাঝে মাঝেই অত মার খায় ছেলেটা, তবুও সুযোগ পেলেই ওই ছুরির খেলা আবার শুরু করে।
আসলে, বিধবা মা শ্রীমতীদির প্রশ্রয় পায়। ওই, বারো বছরের ছেলেটাকে নিয়ে বিধবা শ্রীমতীদি মহাদেব জ্যেঠুর কাছে এসে উঠেছিলো, আজও ছেলে মার খেলে তিনি ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদেন। ছেলেটার চোখেও খুনীর ইসারা দেখেছে অনল।একবার বিল্টু বলেও ছিলো, " একটু বড় হই, বুড়োর গলায় চপার বসিয়ে দেবো".. তখন বকাবকি করলেও, অনল ভেতর ভেতর শিঁটিয়ে গিয়েছিলো।
কি যে পাগলের পাড়ায় বাড়ি বানিয়েছিলে বাবা? নিজে তো দিব্য বাহান্নো পেরতে না পেরতে থ্রম্বসিসে কেটে পড়লে, আমাকে এইসব পাগলের সাথে  মোকাবেলা করতে একা রেখে গেলে! 
বাড়ি,পাড়া সব পাগলের বংশ!
কতদিন ভালো করে ঘুমোতে পারেনা অনল, দুই দুটো বচ্ছর।
জয়ি যখন ছিলো,এসব শব্দ শুনতেই পেতনা সে।
জয়ি যেন একটা অদৃশ্য দেওয়াল উঠিয়ে দিয়েছিলো,যাতে সব শব্দ ঠিকরে ফিরে যেত। সে আজ নেই৷ তাই ওই দেওয়ালটাও গুঁড়ো গুঁড়ো  হয়ে বাতাসে মিলিয়ে  গেছে।
প্রায় ছমাস হলো অতিমারীর জন্য  ইস্কুল বন্ধ। রাতে আজকাল, ঘন ঘন এম্বুলেন্স এর হুটার শোনা যায়। মন ছ্যাঁত করে ওঠে,  কার পালা, কে গেল? চেনা কেউ নয়তো?
মনে পড়ে বিজন ভট্টাচার্যর সেই ভুতুড়ে  গলা " রাইত কতো হইলো, উত্তর মেলেনা...
প্রায় আড়াইটে নাগাধ, অনল টেবিল ল্যাম্পটা নেভাতে যাবে,হঠাৎ  ওই ছোট  আলোর গোলাকারটার মাঝে  একটা কালো মথ এসে বসলো, নাড়াতে লাগলো তার পাখা, তারপর অনল স্পষ্ট করে শুনতে পেল মথটা জয়িতার গলায় বলে উঠলো," ঘুমোতে পারছো না, তাইনা অনী? শুধু তুমি নও, এখন থেকে আর কেউই  শান্তিতে ঘুমোতে পারবে না, সারা জগৎ সংসারকে মানুষ শুধু এতদিন মেরেছে,মেরেছে আর মেরেছে-- সেই মরা দুনিয়ায়  বিষন্নতার অভিশাপ আজ মানুষের জীবনে লেগেছে গো। জেগে থাকাই এখন  আমাদের নিয়তি।"
মথটা খোলা জানলা দিয়ে উড়ে চলে গেল। হারিয়ে গেল বাইরের অন্ধকারে। ভীষণ কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে  বর্ষার অজস্র জলধারায় ভিজছে গোটা পাড়া। হয়তো গোটা কলকাতাটাই।
অবিরাম এই ঝমঝমও কিন্তু  অনলকে তার প্রিয় ঘুম, আজও ঘুমোতে দেবেনা।

গদ্যকার অনিন্দ্য দত্ত
আন্ধেরী পূর্ব, মুম্বাই, ভারত





















মরচে পড়া রাত

থলে ভরতি জংধরা প্রলেপের ভেতর 
হাত ঢুকিয়ে দেখে নিচ্ছি মরচে পড়া রাতের সিম্ফনি

কে যায় কে আসে শীতল জলবায়ুর পথ ধরে 

অ্যালুমিনের ফুটো থালায় সূর্য দেখি রাতের আয়নায় 

ঝুলে পড়া চামড়ার নিচে নিরালা দ্বীপ 
শ্বাপদের চোখে জ্বলে ওঠে চারণভূমি 

মাংসাশী পায়ের ছাপ বুকে নিয়ে 
আজও ঘুম ভাঙে মাঝরাতে 

তালুর যব চিহ্নগুলি দিনে দিনে 
আরও প্রকট লোনালাগা শব্দের ভেতর ।

কবি তুলসীদাস ভট্টাচার্য
শালডাঙ্গা, জগন্নাথপুর, বাঁকুড়া 















স্বপ্ন 

সন্ধে না‌মে হৃদয় প্রা‌ন্তি‌কে                                        শরীর মা‌ঠে জ্যোৎস্না ভে‌সে যায় ।                          সময় দু'‌চোখ হা‌রি‌য়ে যাওয়ার বাঁ‌কে-                        হাত বা‌ড়ি‌য়ে ডাক‌ছে ইশারায় ।

নদীর বুনন ‌বিমুগ্ধ পশ‌মিনা                                হাওয়ার বু‌কে কলমকারি কাজ ।                            রা‌ত্রি কেমন স্বা‌ত্ত্বিক ও রুমানা                              আঁচল ভ‌রে কু‌ড়ো‌চ্ছে মন্তাজ ।

চাঁ‌দের কো‌লে নরম উষ্ণতা                                    চড়কা বু‌ড়ি পলক খুঁ‌জে নামে ।                          চো‌খের কো‌ণে ছড়ায় দৃশ্যতা                                আদর ক‌রে মা‌খি‌য়ে রা‌খে ঘুমে ।

আমরা শুধু জ‌ড়ি‌য়ে নি‌তে পা‌রি                            ঘু‌মের চাদর র‌ঙিন ও অংশুল ।                            মে‌ঘে‌রা‌ ফে‌রে যে পথ দি‌য়ে বা‌ড়ি                            সেই প‌থের ধা‌রেই স্বপ্ন দেখার স্কুল

কবি অমর্ত্য দত্ত 
বৌবাজার, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ 

















বিষণ্ণতা

চাহিদার বাজার উড়ে গেলেই 
চৌমাথা মোড়ের সবজি কাকি মা'র
আঁচলে নেমে আসে অনির্বাচিত বিষণ্ণতার ঢেউ ।
ঝড়ে বাসা ভাঙা পাখির মতো 

অস্থির মন,
ভাড়া দোকান ঘর 
সামনে থরে বিথরে সাজানো সবজি ডালায় 
সত্তরোর্দ্ধ গালের মতো চুপসে বসে আছে 

ঝাপসা দেখায়,চোখে চশমা
তারপরও মহানন্দার জল বড্ড ঘোলা হয়ে                      ভেসে আসে চোখে

মন্দার বাজার ,টেনশন কেরিব্যাগে ভরা 

বিছানায় শুয়ে প্রিয় ঘুমের অপেক্ষায় ...
আমার ছোটবেলার সবজি কাকি মা 

কবি বর্ণজিৎ বর্মন 
গোসানিমারি, কোচবিহার, পশ্চিমবঙ্গ 

























 

স্বপ্ন

আমার স্বপ্নে দেখা এ রকম লালল মেলা কি
আদৌ পৃথিবীতে হয়!

জল খেতে উঠেই আবার ঘুমিয়ে পড়ি
বাকিটা দেখার জন্য। 
অথচ ওটা নয়, 
দেখি--- অন্য এক অকল্পনীয় মজাদার গ্রহের কাহিনি।

টয়লেট সেরে এসে চটপট শুয়ে পড়ি আবার
ওই গ্রহের সুন্দর সুন্দর পাখিগুলোকে
আরও একবার মন ভরে দেখব বলে
কিন্তু যেই শুই 
কোথায় সেই গ্রহ! 
কোথায় সেই লালন মেলা! 
শুরু হয়ে যায় অন্য, একেবারে অন্য
একেবারেই অন্য আর একটা স্বপ্ন। 
কিন্তু যখনই সেই সব স্বপ্নের দৃশ্য তুলব বলে
                                           পকেটে হাত দিই
দেখি, মুঠোফোনে চার্জ নেই
অথবা হাতড়ে হাতড়ে কিছুতেই খুঁজে পাই না
                                           কোথায় রেখেছি
কিংবা মনে পড়ে যায়, আগের রাতেই চলন্ত বাসে
              পকেটমার হয়ে গেছে আমার মোবাইল।

ঝট করে উঠে বসি। 
আবার যখন শুই, দেখি--- 
অন্য, একেবারেই অন্য
অন্য আর একটা নতুন স্বপ্ন...


 সাহিত্যিক সিদ্ধার্থ সিংহ
২৭/পি, আলিপুর রোড, কলকাতা 


































নবীনতর পোস্টসমূহ পুরাতন পোস্টসমূহ হোম

ব্লগ সংরক্ষাণাগার

  • আগস্ট (3)
  • জুলাই (22)
  • জুন (8)
  • নভেম্বর (15)
  • অক্টোবর (5)
  • সেপ্টেম্বর (81)
  • আগস্ট (66)
  • জুলাই (55)
  • জুন (56)
  • মে (57)
  • এপ্রিল (46)
  • মার্চ (15)
  • জানুয়ারী (14)
  • ডিসেম্বর (73)
  • নভেম্বর (103)
  • অক্টোবর (97)
  • সেপ্টেম্বর (101)
  • আগস্ট (120)
  • জুলাই (88)
  • জুন (76)
  • মে (63)
  • এপ্রিল (11)

🔴বিজ্ঞপ্তি:

পাঁচ মাসের বিরতি কাটিয়ে আবার ও ফিরছি আমরা। খুব শীগ্রই আসছে আমাদের প্রত্যাবর্তন সংখ্যা।

অনুসরণ করুণ

এক মাসের সর্বাধিক পঠিত পোস্টগুলি:

  • শেষ শোকসংগীত ~ গোবিন্দ মোদকের কবিতা
  • দুটি কবিতায় ~ গৌতম কুমার গুপ্ত
  • ব্রাত্য ~ বিদ্যুৎ মিশ্র'র কবিতা
  • দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প
  • আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা
  • গুচ্ছ কবিতায় ~ অসীম মালিক
  • সুমিত রায়ের গল্প
  • সে প্রেম পবিত্র~ প্রেমাংশু শ্রাবণের কবিতা
  • সুব্রত মাইতির কবিতা
  • তিনটি কবিতায় ~ রাগীব আবিদ রাতুল

বিষয়সমূহ

  • Poetry speaks 2
  • অণু কথারা 21
  • আবার গল্পের দেশে 8
  • উৎসব সংখ্যা ১৪২৭ 90
  • একুশে কবিতা প্রতিযোগিতা ২০২১ 22
  • এবং নিবন্ধ 3
  • কবিতা যাপন 170
  • কবিতার দখিনা দুয়ার 35
  • কিশলয় সংখ্যা ১৪২৭ 67
  • খোলা চিঠিদের ডাকবাক্স 1
  • গল্পের দেশে 17
  • ছড়ার ভুবন 7
  • জমকালো রবিবার ২ 29
  • জমকালো রবিবার সংখ্যা ১ 21
  • জমকালো রবিবার ৩ 49
  • জমকালো রবিবার ৪ 56
  • জমকালো রবিবার ৫ 28
  • জমকালো রবিবার ৬ 38
  • দৈনিক কবিতা যাপন 19
  • দৈনিক গল্পের দেশে 2
  • দৈনিক প্রবন্ধমালা 1
  • ধারাবাহিক উপন্যাস 3
  • ধারাবাহিক স্মৃতি আলেখ্য 2
  • পোয়েট্রি স্পিকস 5
  • প্রতিদিনের সংখ্যা 218
  • প্রত্যাবর্তন সংখ্যা 33
  • প্রবন্ধমালা 8
  • বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা 10
  • বিশেষ সংখ্যা: আমার প্রিয় শিক্ষক 33
  • বিশেষ সংখ্যা: স্বাধীনতা ও যুবসমাজ 10
  • ভ্রমণ ডায়েরি 1
  • মুক্তগদ্যের কথামালা 5
  • রম্যরচনা 2
  • শীত সংখ্যা ~ ১৪২৭ 60

Advertisement

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.

মোট পাঠক সংখ্যা

লেখা পাঠাবার নিয়মাবলী:

১. শুধুমাত্র কবিতা, মুক্তগদ্য অথবা অণুগল্প পাঠাবেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং অন্যান্য বিষয়ক লেখা সম্পূর্ণ আমন্ত্রিত। ২. লাইনের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ৩. লেখা মেইল বডিতে টাইপ করে পাঠাবেন। ৪. লেখা মৌলিক ও অপ্রকাশিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্য কোনো ব্লগ, ওয়েবজিন অথবা প্রিন্টিং মিডিয়ায় প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ৫. মেইলে আপনার লেখাটি সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত, কথাটি উল্লেখ করবেন। ৬. লেখার সাথে আবশ্যিক ভাবে এক কপি ছবি ও সংক্ষিপ্ত ঠিকানা পাঠাবেন।  ৭. লেখা নির্বাচিত হলে এক মাসের মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হবে। এক মাসের মধ্যে কোনো উত্তর না এলে লেখাটি অমনোনীত ধরে নিতে হবে। ৮. আপনার লেখাটি প্রকাশ পেলে তার লিঙ্ক শেয়ার করাটা আপনার আবশ্যিক কর্তব্য। আশাকরি কথাটি আপনারা মেনে চলবেন। আমাদের মেইল- hridspondonmag@gmail.com
blogger-disqus-facebook

শান্তনু শ্রেষ্ঠা, সম্পাদক

আমার ফটো
পূর্ব বর্ধমান, India
আমার সম্পূর্ণ প্রোফাইল দেখুন

সাম্প্রতিক প্রশংসিত লেখা:

সুজিত রেজের কবিতা

সুজিত রেজের কবিতা

চন্দ্রানী গুহ রায়ের কবিতা

চন্দ্রানী গুহ রায়ের কবিতা

দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প

দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প

আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা

আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা

কবি সুধাংশুরঞ্জন সাহার কবিতা

কবি সুধাংশুরঞ্জন সাহার কবিতা

হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন

© হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন। শান্তনু শ্রেষ্ঠা কর্তৃৃক পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত থেকে প্রকাশিত।

Designed by OddThemes | Distributed by Gooyaabi Templates