বিষণ্ণতা ও প্রিয় ঘুম
মাথায় যেন পিন ফুটছে। বেসিনে টপ্ টপ করে জল পড়ছে। শেফালিদি আবার বাসন ধুয়ে ট্যাপটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে। বলে বলে আর পারা গেলনা, পিসিমা বলেন, মা বলে, অনল নিজেও কতবার বলেছে,তবু এ স্বভাবে শেফালিদির শোধরাবার নয়।এতদিন তাদের সংসারে আছে যে বেশি কিছু বলাও যায়না। সেই অনলের যখন ছয় বছর বয়েস তখন এই বাড়িতে ঢুকেছে সে, আর আজ অনলেরই তিরিশ হলো। এখন এই জল ঝরা যদি নিজে থেমে যায়, তবে রক্ষে, নয়ত সারারাত জ্বালাবে এই সর্বনেশে শব্দ। এখন তো গিয়ে ট্যাপটাকে এঁটে দিয়ে আসাও যাবেনা, কারন রান্নাঘরে যেতে হলে তো পিসিমার ঘরের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে।
সবে ঘুমের ওষুধ খেয়ে তিনি চোখ বুজেছেন, এখন তাঁর কোনো কারনে ঘুম ছুটে গেলে, সারারাত ছটফট করবেন,আর বিলাপ করবেন। অসহ্য লাগে অনলের,সব কিছুই অসহ্য লাগে তার,এই পিসিমার বিলাপ, মায়ের অর্থহীন বকরবকর, পাড়ার ছেলেদের রাতে বিকট গর্জনে বাইক চালানো, মাইকে পঞ্চাশ বার একই গান, হুলোদের ঝগড়া অথবা মেনীদের প্রতি তাদের চাঁদনী রাতে তারস্বরে প্রেম নিবেদন, দেবাশিষদের বাড়ির টিয়াটার হঠাৎ রাধে রাধে বলে ফুকরে ওঠা, সব,সব।আচ্ছা,কোনো টিয়া রাতে চেঁচায়? এটা নিশ্চয়ই তারকাটা টিয়া।
রাতে বিরক্ত করবার আরেক গুরুমশাই তো বাড়িতেই আছেন। অনলের সাক্ষাৎ বড়মামা শ্রী অজিত মিত্র। আরে হনুমান চল্লিশা বা শিবস্ত্রোত্র পড়তে হয় তো, নিজের ঘরে বসে মনে মনে পড়োনা, তা নয়, রাত এগারোটা বাজলো তো প্রাত্যহিক হেঁড়ে গলায় জয় হনুমান অথবা ওম নমঃ শিবায়, শিবায় শুরু হয়ে গেল। আবার অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে ওম জবাকুসুমসঙ্কাশন চালু হয়ে গেল। যা নারে ভাই, ভোর বেলা মর্নিওয়ার্কে গিয়ে যতখুশী সূর্য বন্ধনা করনা, তা নয়, মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো। নিজের তো ইনসমনিয়া, তার সাথে গাউট থাকায় মর্নিওয়াকও বন্ধ। তাই ঘরে বসে বাড়ির লোকের উপর এই অত্যাচার।
বারোটার আগে এই বাড়িতে ঘুম নামে না।বিছানায় শুয়ে নাইট ল্যাম্পের আলোয় কিছুক্ষন বই পড়বার পর সপ্তাহের সাত দিনে পাঁচ দিন অনলের খিদে পেয়ে যায়। ডঃঘোষ পরিস্কার বলেছিলেন, এটে তীব্র ডিপ্রেশন থেকে হোচ্ছে, না হলে সাড়ে দশটায় পেট ভরে খেয়ে সাড়ে বারোটায় আবার খিদে পেতেই পারেনা
অনল জানে, এ খিদে অন্য খিদে, দুই বছর হয়ে গেল জয়িতা বাচ্ছা হতে গিয়ে দেওয়ালে ছবি হয়ে গেছে,বাচ্ছাটাও গেছে মার সাথেই।
অনল ভাবে, বেঁচে গেছে সে। যদি মাহারা বাচ্ছাটা বেঁচে থাকতো, তার দায়িত্ব নিতো কে? সে তো জেরবার হয়ে যেত।
একটা সরকারি ইস্কুলের ইতিহাস আর আঁকার মাস্টার সে।
ইস্কুলে শেখানো ছাড়াও নিজের সিরিয়াস কাজ সে খুব মন দিয়েই করে।।বছরে একটি গ্রুপ প্রদর্শনী এবং দুতিনটি ছবি বিক্রি তার বাঁধা।আর্টের বইগুলোর পাতা উল্টোতে উল্টোতে হতাশায় মন ভোরে যায় তার। কতরকমের কাজ হচ্ছে দেশে-বিদেশে, তার বন্ধুরাও কত বিমূর্ত কাজ করে৷ কিন্তু সে আঁকতে গেলেই হয় ল্যান্ডস্কেপ নয় সিটিস্কেপ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও বিক্রি হয় সে সব তবুও যথেষ্ঠ আধুনিক না হতে না পারার জন্য, সে বন্ধুদের মাঝে মরমে মরে থাকে সবসময়।
মা আর পিসিমা বহুবার তাকে আবারও বিয়ে করতে বলেছেন। কিন্তু তার মন অন্য ধাতুতে গড়া, জয়ির বিছানায় সে অন্য কাউকে ভাবতেই পারেনা আজও। তবুও,মানুষের শরীর তো,শয্যা মাঝে মাঝে তীব্র হয়ে ওঠে,তখন ল্যাপটপে নীল ছবি ছাড়া গতি নেই।সেটাও শব্দ বন্ধ করে দেখে সে, সেটার যদিও কোনো দরকারই নেই, কারন গভীর রাতে তার ঘরে কেইবা আসতে যাচ্ছে, তবু কেমন যেন লজ্জা করে অনলের।
উল্টোদিকের বাড়িতে দীগিনবাবুর ষোলো বছরের ছেলে অভীক জড়বুদ্ধি। গহণ রাতে হঠাৎ বিশ্রী গলায় গেয়ে ওঠে," আলোকের এই ঝরনা ধারায় ধুইয়ে দাও, দাও,দাও.." শুনতে খুব খারাপ লাগে, তবুও শুনতে শুনতে গলার কাছে কি যেন আটকে আসে। নিজের জন্ম না নেওয়া বাচ্ছাটার কথা মনে হয়। যদি এরকম হোতো তারও ভাগ্যে!
আর একটা আওয়াজ, যেটা শুনলে গায়ের সব রোঁয়া দাঁড়িয়ে যায়,সেটা হলো কাঠের উপর ছুরির ঘষা। যেটা করে পাশের বাড়ির বুল্টু। মহাদেব জ্যেঠুর নাতি।রাত দেডটা দুটোর সময় তার কাঠের বেঞ্চে ছুরির কাজকর্ম শুরু হয়। খ্যাঁচ, খ্যাঁচ, ক্যাঁচ, ক্রঁচ...আগুন ছুটতে থাকে অনলের মাথায়।
তবে মহাদেব জ্যেঠু ও ইনসমনিয়ার রুগী। একটু পরেই শুরু হয় গোবেড়েন এর পালা।আশ্চর্য, মাঝে মাঝেই অত মার খায় ছেলেটা, তবুও সুযোগ পেলেই ওই ছুরির খেলা আবার শুরু করে।
আসলে, বিধবা মা শ্রীমতীদির প্রশ্রয় পায়। ওই, বারো বছরের ছেলেটাকে নিয়ে বিধবা শ্রীমতীদি মহাদেব জ্যেঠুর কাছে এসে উঠেছিলো, আজও ছেলে মার খেলে তিনি ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদেন। ছেলেটার চোখেও খুনীর ইসারা দেখেছে অনল।একবার বিল্টু বলেও ছিলো, " একটু বড় হই, বুড়োর গলায় চপার বসিয়ে দেবো".. তখন বকাবকি করলেও, অনল ভেতর ভেতর শিঁটিয়ে গিয়েছিলো।
কি যে পাগলের পাড়ায় বাড়ি বানিয়েছিলে বাবা? নিজে তো দিব্য বাহান্নো পেরতে না পেরতে থ্রম্বসিসে কেটে পড়লে, আমাকে এইসব পাগলের সাথে মোকাবেলা করতে একা রেখে গেলে!
বাড়ি,পাড়া সব পাগলের বংশ!
কতদিন ভালো করে ঘুমোতে পারেনা অনল, দুই দুটো বচ্ছর।
জয়ি যখন ছিলো,এসব শব্দ শুনতেই পেতনা সে।
জয়ি যেন একটা অদৃশ্য দেওয়াল উঠিয়ে দিয়েছিলো,যাতে সব শব্দ ঠিকরে ফিরে যেত। সে আজ নেই৷ তাই ওই দেওয়ালটাও গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
প্রায় ছমাস হলো অতিমারীর জন্য ইস্কুল বন্ধ। রাতে আজকাল, ঘন ঘন এম্বুলেন্স এর হুটার শোনা যায়। মন ছ্যাঁত করে ওঠে, কার পালা, কে গেল? চেনা কেউ নয়তো?
মনে পড়ে বিজন ভট্টাচার্যর সেই ভুতুড়ে গলা " রাইত কতো হইলো, উত্তর মেলেনা...
প্রায় আড়াইটে নাগাধ, অনল টেবিল ল্যাম্পটা নেভাতে যাবে,হঠাৎ ওই ছোট আলোর গোলাকারটার মাঝে একটা কালো মথ এসে বসলো, নাড়াতে লাগলো তার পাখা, তারপর অনল স্পষ্ট করে শুনতে পেল মথটা জয়িতার গলায় বলে উঠলো," ঘুমোতে পারছো না, তাইনা অনী? শুধু তুমি নও, এখন থেকে আর কেউই শান্তিতে ঘুমোতে পারবে না, সারা জগৎ সংসারকে মানুষ শুধু এতদিন মেরেছে,মেরেছে আর মেরেছে-- সেই মরা দুনিয়ায় বিষন্নতার অভিশাপ আজ মানুষের জীবনে লেগেছে গো। জেগে থাকাই এখন আমাদের নিয়তি।"
মথটা খোলা জানলা দিয়ে উড়ে চলে গেল। হারিয়ে গেল বাইরের অন্ধকারে। ভীষণ কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে বর্ষার অজস্র জলধারায় ভিজছে গোটা পাড়া। হয়তো গোটা কলকাতাটাই।
অবিরাম এই ঝমঝমও কিন্তু অনলকে তার প্রিয় ঘুম, আজও ঘুমোতে দেবেনা।
গদ্যকার অনিন্দ্য দত্ত
আন্ধেরী পূর্ব, মুম্বাই, ভারত