🔸প্রবন্ধ:
🔰শুভায়ন বসু🔹দুর্গাপুর
📘চারদিকে গুমোট গরম,বিরক্তিকর।সেই একইভাবে এই নতুন শহরে দিনগুলোও কেটে যাচ্ছে ।নানা রকম ভাবে কেটে যাচ্ছে।কিন্তু ভীষণই মনে হচ্ছে, যে সেরকম কিছুই ঘটছে না,বিশেষ কিছুই করা হচ্ছে না ,বড় কোনো প্রাপ্তি ঘটছে না, হুট করে এসে পড়ছে না কোনো বন্ধু বা আত্মীয়, অবাক করা আনন্দজনক কোন খবরও থাকছে না ,এমনকি রাস্তায় হুট্ করে দেখাও হয়ে যাচ্ছে না পুরোনো প্রেমিকার সঙ্গে।দিনগুলো কেটে যাচ্ছে একেবারে কিচ্ছু না ঘটিয়ে। যদিও চারপাশে দুর্বোধ্য অনেক কিছুই ঘটছে, তবুও আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, করা হচ্ছে না বা বলা হচ্ছে না গুরুত্বপূর্ণ কোনকিছুই। অন্ততঃ মিটিয়ে ফেলা যাচ্ছে না একটাও পুরোনো ফয়সালা। নতুন দেশের নানা রকম নতুন লোকের সঙ্গে অবশ্য পরিচয় হচ্ছে, প্রত্যেককেই ভাল লাগছে আর মনের মধ্যে প্রত্যেকের অস্তিত্বই স্পষ্ট হয়ে বসে যাচ্ছে। কাউকেই ভোলা যাচ্ছে না, এমনকি যে লোকটা খুব একটা ভালো নয় বলে অন্যরা বলেছিল, তাকেও ভালো লাগছে, মনে থাকছে, শুধু এই জন্যই যে এও একটা ধরন। তাছাড়া কোনো মানুষই পুরো ভালো বা পুরো খারাপ হয় না, খারাপ লোকের মধ্যেও খুঁজলে কিন্তু কিছু কিছু ভাল গুণ দেখতে পাওয়া যাবে । আমার বাড়িতে একটা সুন্দর পোস্টার আছে,এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল ।সেটার মোদ্দা কথাটা এইরকম যে,জীবনের যাত্রাপথে গন্তব্যে পৌছোনটাই বড় নয়,যাত্রাপথটাকে উপভোগ করা আর তার ছোট ছোট অসংখ্য জিনিসকে মনের খোরাক করে নেওয়াটাই বড়।কারণ গন্তব্যের শেষটা নয়,পথ চলার মধ্যবর্তী আনন্দ আর অভিজ্ঞতাটাই আসল।
শুধু এই জন্যই মাঝে মাঝে ভীষণ ভালো লাগে নিজেকে, ভালো লাগে পৃথিবীকে, ভালো লাগে প্রকৃতিকে। ভালোবেসে ফেলি সবাইকে ,চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে "আমি ভালবাসি"। কতদিন বাঁচব আমি জানিনা, কিন্তু যতদিন বাঁচব জীবনকে জানা-বোঝার সুযোগ থেকে যেন বঞ্চিত না হই। নানাভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে, নানা অনুভূতি, অভিজ্ঞতা নিজের করে নিতে ইচ্ছে করে ।কিন্তু এই একটা জীবনে কত কিছু করা সম্ভব? এই যেমন চলে যেতে ইচ্ছে করে সারা পৃথিবীর দুর্গমতম প্রান্ত গুলোতে, সুন্দরতম জায়গা গুলোতে, মিশে যেতে ইচ্ছে করে মানুষের মধ্যে,সেনাবাহিনীর হয়ে মরণপণ যুদ্ধে লড়ে যেতে ইচ্ছে করে, সমাজের অন্যায় গুলোর বিরুদ্ধে ঘা দিতে,রুখে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে,লিখে ফেলতে ইচ্ছে করে দারুন সব কবিতা, এঁকে ফেলতে ইচ্ছে করে নতুন ধরনের ছবি ,প্রচুর বই পড়তে ইচ্ছে করে, অনেক কিছু শিখতে ইচ্ছে করে,নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেলতে অথবা মাস্তানের উপর মাস্তানি করতে, দাগী অপরাধীদের ভীষণ শাস্তি দিতে, সারাদেশের মানুষের কাছে ভীষণ আদর্শ হতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু এত কিছু এই একটা জীবনে করা সম্ভব নয়, এতভাবে বাঁচার পক্ষে জীবনটা বড়ই ছোট। তখনই মনটা খারাপ হয়ে যায়। জীবনটা শেষ হয়ে এলো, অথচ কত কিছু করার বাকি থেকে গেল ।কত পথে হেঁটে যাওয়া হলো না, কত মুখ চেনা হল না, কত কি দেখা হল না,কত ভুল শুধরোনো হলো না, আর হবেও না হয়তো। এই হল জীবনের ব্যর্থতা।
এইমাত্র কড়কড় করে মেঘ ডাকল, বৃষ্টি এখনই শুরু হবে। কিন্তু এই দূষিত পরিবেশে, ধোঁয়া আর ধুলোর মধ্যে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগে না।মনে হয় ,এখন যদি থাকতাম হিমালয়ের কোলে কোন ফুলের বাগানের মধ্যে ,একটা কাঁচের বাড়িতে বা পাহাড়ের ঢালে বয়ে চলা কোন ঝর্ণার পাথরের খাঁজে ,অথবা দিগন্তব্যাপী সবুজ ধান ক্ষেতের মধ্যে একটা খড়ের গাদায় হেলান দিয়ে শুয়ে, তবে বৃষ্টি দেখতে বেশ লাগতো। সেই সঙ্গে অনেক মন কেমন এসে জমা হত, অনেক কথাও। কিন্তু এই পাথুরে পরিবেশ, এই শব্দ, ধোঁয়া-ধুলো ,এর মধ্যে বৃষ্টি এসে সেই মনের আরাম দেয় না।তাই কথারাও আসে না।তাই এখানে আমি একা, ভীষন একা ,একেবারে একা। নিজে নিজেই রান্না করি, নিজে নিজেই খাই ।কখনো রান্না করি না, খাইও না। ঘরের সব কাজ নিজেই করি ,কেউ কিছু বলার নেই। হরেক রকম বই পড়া, খবরের কাগজ পড়া, গান শোনা, টিভি দেখা, সব একা একা। একাই গল্প পড়ি ,হাসি, কাঁদি, কিছুতেই সময় কাটে না। মাঝে মাঝে একাকিত্বের জন্য চোখ ফেটে কান্না আসে, নিজেই দেখি নিজের কান্না ,নিজেই মুছে ফেলি ।বাড়ির কথা মনে পড়ে। তক্ষুনি চলে যেতে ইচ্ছে করে ,সবার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে।বাড়ির, পাড়ার খবর জানতে ইচ্ছে করে। আমার ভীষণ প্রিয় কলকাতা শহরটায় ছুটে যেতে চায় মন। কিন্তু আমাকে একা বাড়িতে বিষন্ন ফেলে রেখে প্রতি সন্ধ্যাতেই ছটা পনেরোর লাস্ট ট্রেন ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস শব্দ করে ছুটে চলে যায় কলকাতার দিকে।চোখে জল এসে যায় অভিমানে। এই ভাবেই প্রতি সন্ধ্যাতেই ট্রেন মিস করে চলেছি ।প্রতিবারই সেই একই আফশোষ। কে আমাকে ট্রেন ধরিয়ে দেবে? অনেকদিন কবিতা লিখি না, এই পরিবেশে কবিতা হয়না। কবিতা সৃষ্টির মত, মনে কোন আনন্দ হয়নি ,বড়ই নীরস জীবনটা।এখন কবিতা শুধু পড়তে চেষ্টা করি, তাও বেশিক্ষণ ভালো লাগেনা ।কত ভালোলাগা কবিতা এইটুকু মনের পরিসরে জায়গা দিতে পারি না ।খুব খারাপ লাগে, কিন্তু জানি ,জীবন এরকমই। কতটুকু জায়গা হয়, কতটাই বা হাত গলে পড়ে যায়।
বৃষ্টি শুরু হল। সেই শব্দ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ভালোবাসার যদি কোন রূপ থাকতো ,তাহলে তা যেন এই কালবৈশাখী ঝড়ের রুপই হয়। বিকেলে খোলা মাঠে একা আমাকে এসে যে জানিয়ে দিয়ে যাবে ,সে আছে এবং থাকবে। চুপিচুপি কোন মনের কথা, প্রাণের রেশ সেই ঝড়ের মুখ থেকেই ঝরে পড়বে হৃদয়ের সবচেয়ে দামি সম্পদের মতো ,অথচ যা বিলিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা নেই ,লজ্জ্বা নেই, শঙ্কা বা অহংকার নেই ।ভালোবাসার যদি কোন রং থাকত ,তবে তা হতো সূর্যাস্তের গেরুয়া রং। দিনের শেষে জানিয়ে দেবার জন্য সবচেয়ে দামি সেই রঙ কোন বিভেদ মানে না, আকাশের প্রতিটি কোণে তার প্রকাশ জানিয়ে দিয়ে তবে সে বিদায় নেয়। আমাদেরও শুধু সেই রংয়েই হারিয়ে যেতে হবে একদিন ।ভালোবাসার যেমনই প্রকাশ হোক না কেন, তা আমার হাতের তালুর মতই চেনা ,আমার সহজ জীবনবোধ ,সাবলীল আবেগের সঙ্গে কোথাও তার বিরোধ নেই ।সে যে আমিই। তাই ভালোবাসা আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে দামী অংশ, সবচেয়ে সত্য,সর্বদা অটুট এবং খুবই স্বাভাবিক ।তা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। ভালোবাসার যদি কোন রূপ থাকত ,তা সেই অল্প চেনা পাড়াতুতো প্রেমিকাতেই প্রকাশিত হত,আর তো কেউ কখনো নেই আমার! ভালবাসার যদি কোন রং থাকত, তা তো তারই সেই রং ,'হলুদ বসন্ত' পাখির সবচেয়ে নীল পালকটি। ভালোবাসা যদি ভুল হয় তো সেই , ভালোবাসা যদি জীবনের পরম প্রাপ্তি হয় তা হলেও সেই। একই সঙ্গে ভালোবাসার শুরু এবং শেষ, মায়া এবং বাস্তব ,প্রকাশ এবং প্রলয়। সেই আমার উন্মাদনা ও আবেগ, আমার পিটুইটারির খেলা ।তার জন্যই আমার দেহ মনের সমস্ত স্পর্শ সংরক্ষিত ,কেবল সেই তা অনুভব করতে পারবে একদিন।।তার- আমার হয়ত কোনদিনই সবুজ হওয়া হয়ে উঠবে না, তবু বলছি, দূর থেকেই বলছি ,কবিতার অনুরণন যে আমাকে পাগল করে তোলে, তা হয়তো বা সেই একদিন প্রকৃত বুঝতে পারবে ,যেদিন হয়তো আমিই থাকব না। তখন কোন দুপুরবেলা হঠাৎ নীল আকাশে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট চিলটার দিকে তাকিয়ে, তার আমার কথা মনে পড়ে যাবে, আর তখনই ঠিক, তাকে কাঁদিয়ে যাবে আমার না লেখা কবিতা ।যদিও কবি পরিচয়ে আমি বিন্দুমাত্র গর্বিত বোধ করি না,কারণ আমি আদৌ কোনদিনও কবি হতে চাই না।বরং এও জানি,আমার না লেখা কবিতা সেই লিখবে-একদিন।
আমার একান্ত আপনার জনের বিষয়ে আমার আদৌ কোনো ভরসা নেই। আমি জানি সেই একজনকে আমি কোনদিনও পাবনা ।যে একদিন আমার হবে ,সে হয়ত কোনদিনই আমার কবিতা বুঝবে না ,দিন আনি- দিন খাই ভালোবাসার রাতে লাল নাইটল্যাম্পের তলায় শুয়ে নীরবে কেঁদে যাবে আমার কবিতা ।সেই একজন হতে পারত শুধু সেই বর্ষপ্রেমিকা,অথচ নামহীন সম্পর্কের নদীতে ,পাতার নৌকা হয়েই সে হয়ত চিরকাল ভেসে যাবে ।তার কাছে থাকতে পারছি না,ইচ্ছে না হলেও বাধ্য হয়েছি তাকে কলকাতার পথচলতি ফুটপাতের কাছে ছেড়ে আসতে।সেখানে আমার কোনো জোর নেই, ভিড়ে হারিয়ে যাবার পর কত সহজেই, তার প্রতি আমার সব দাবী হারিয়ে যায় ।কিন্তু,সে কাছে থাকুক বা দূরে ,তার সংজ্ঞা ,তার স্মৃতি, আমার মনের সবচেয়ে দামি ঘরে তালাবন্ধ হয়ে আছে ,আর সেই ঘরের ভেতরে প্রবেশাধিকার শুধুমাত্র আমার।
বৃষ্টি শেষ হল। আকাশ নীল, সজীব হয়ে উঠেছে ।আমি তবুও খুঁজে চলেছি নিজেকে নতুন করে পাবার জন্য, যেমন সবুজ ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে দৌড়ে যাবার সময় কোন কিশোর নিজেকে খুঁজে পায়। তবু কেন আমি ধান ক্ষেতের মধ্যে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকা সেই কাকতাড়ুয়া হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছি ,কে জানে? আমি ভগবান মানি না ,তবে যে পদ্ধতিতে মানুষের সৃষ্টি ,সেই বিজ্ঞানের সূত্র ধরেই বলছি, বিজ্ঞান আমাদের যে দৃষ্টি দিয়েছে, যে মন দিয়েছে, তা সবার চেয়ে দামী ,যে আবেগ দিয়েছে , সৃষ্টিশীলতা দিয়েছে, লেখার হাত দিয়েছে,তা তো শুধু সেই বর্ষপ্রেমিকাকে সারা জীবন ধরে বুঝবো বলেই।একথাই আমাকে আজ শান্তিতে রেখেছে, জীবনের সমস্ত ওঠা-পড়া,দুঃখ ,অভিমান একাকিত্বে পাশে থেকেছে, উৎসাহ দিয়েছে ,বলেছে আমার নাম আর আমার সমস্ত আবেগ, চেতনা আর বোধের মূল্য আছে ,প্রাণ আছে- আছে ভালবাসার টান- তার কাছে, যা কখনই শেষ হয়ে যেতে পারে না । এইসবই আমার জীবনের অপরূপ প্রকাশ, আমার হৃদয়ের উৎস এবং মোহনা, আমার পরিপূর্ণতা কেবল সেই আনতে পারে। এ ছাড়া আমার আর কিছুই বলার নেই। অল্প জানা প্রেমিকাকে কোনদিনও ভুলব না ,ভুলতে চাইও না। তারই সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমার জুতোর সুকতলা তিনবার বদলাতে হয়েছে, ম্যানেজারের চোখরাঙানি সইতে হয়েছে, মাত্র সাতটা ছুটি বাকি থাকতেও দুটো ছুটি নিয়ে ফেলেছি সম্পূর্ণ বিনা কারণে ,এমনকি সাইকেলের রিম বেঁকিয়ে ফেলে কড়কড়ে ছাব্বিশ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়েছে মুরারী মিস্ত্রির কাছে। অপ্রস্তুতে পড়তে হয়েছে বন্ধুদের মাঝে, ধরা পড়তে হয়েছে এমনকি বাবা-মার কাছেও। তবু তাকে ছাড়িনি। বেদম মার খেয়েও তারই সঙ্গে থেকে গিয়েছি, থেকে যাবো, তাকে রেখে দেবো আমার মনে ।কিছুতেই যেতে পারবে না সে, এই বন্দীদশা চিরকালের ।এখানেই আমাদের সবুজ হওয়া। আমিও জানি, প্রকৃত প্রেমকে ঘরের বিছানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায় না।তাই দূরে চলে যাবার মধ্যে যে ভীষণ আবেগ লুকিয়ে আছে, যে পাগল করা ভালবাসার মন কেমন করা আছে, তাতেই ভালোবাসার গুরুত্ব শতগুণ বেড়ে যায়। আরো ভালবেসে ফেলি সেই অবিনশ্বরীকে। তবু শেষমেষ তাকে বিদায় দিতেই হয়। সন্ধ্যে নামার আগে, সূর্যের শেষ আলোর মতো তার গেরুয়া স্নিগ্ধতার রং সাদা চোখে মুখে মেখে নিয়ে, তাকে হারাতে হয়।জীবনযুদ্ধে হার নয়,তা শুধু তার মনের কোণে নতুন করে জায়গা পাব বলেই ,আর হঠাৎ এক বর্ষার দিনে আকুল কান্নায় তাকে আবারও মনে পড়বে বলে।সেইখান থেকেই আমার আবার নতুন পথচলা শুরু হয়। পেছনে পড়ে থাকে সমস্ত স্বার্থান্বেষীদের কাতরোক্তি, লোভী আর হিংসুটেদের বড় লোলুপ চোখ, হিংসার রক্তাক্ত ছুরি।সমস্ত বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ,মলিকুলার ফিউশন আর ফিশনকে মাড়িয়ে চলি আমি, সমস্ত পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আমি খুঁড়ে ফেলি সুড়ঙ্গ, এমনকি সমুদ্রের তলা থেকে কুড়িয়ে আনি মুক্তোঝিনুক, শুধু একজনকেই দেব বলে। এইভাবেই চলতে থাকে আমার জীবনযাপন ।সবাইকে পেরিয়ে নিমেষে চলে যাই অজানা লক্ষ্যে আলোয় পথ ধরে, অমোঘ চোখের ডাকে।আমার চলা একদিন শেষ হবে, যেদিন জীবনের লক্ষ্যে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে শুধু আমারই একটুকরো সবুজ দিন। সেই সবুজ বৃষ্টিতে আমি বুক পেতে দেব।আমার চোখ, মুখ, গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে,আমার সারা শরীর ভিজিয়ে ,আমার সবুজ হবার পালা ।
সেই সমাপ্তি তো একান্ত আমার নিজের, কিন্তু সেই নদীকে তো বাঁচতে হবে,তাকে তো আমায় হারাতেই হবে। সেদিন সে শেষবারের মতো আমাকে হারাবে, এমনকি আমিও হারাবো তাকে । আমি আমার হৃদয়ের নিঃশেষিত আবেগ আর অস্তিত্ত্ব,তার হাতে দিয়ে যেতে পারিনি ,শুধু তারই হতে পারিনি, তাকে কাছে টেনে নিতে পারিনি ।এই পথে চলতে চলতে, আমি আমার সীমিত হাতের তালুতে তাকে ধরে রাখতে পারিনি, আমার ছোট্ট ঘরের কোণে দুধেল বিছানায় তাকে নিয়ে যেতে পারিনি।এ আমার ব্যার্থতা নয়, এ হলো এই পথের ইতিহাস।তাই সে চলে গেছে তার নিজের ছন্দে, সুরে, জীবনবোধে ।সে যেন নদী হয়ে বয়ে চলে গেছে আমার তৃষিত বালুচর সবুজে ভরিয়ে দিয়ে।সে স্থান-কাল-পাত্র, জীবন-মরণ, পার্থিব-অপার্থিবের হাতের পুতুল নয়,সে চিরন্তনী বহমান,সে আবেগ সঞ্চারী চেতনার নদী, সে বর্ষা।
আমার কাছে জীবনের বেশ কিছু অনুভূতির দাম এত বেশি যে তারা আমাকে আবেগ-বিহ্বল করে তোলে মাঝে মাঝে। সবখানেই একটা সুতোর টান থেকে যায়। যতই দূরে থাকি না কেন, ভীষণ চেনা হয়ে চিরকালের জন্য গেঁথে থাকে সেই অনুভূতিগুলো ,সেই স্মৃতিগুলো ।সেই ভালোবাসার টান আমাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। পাগল করে দেয়, তাড়িয়ে বেড়ায়,আর আমার জৈবিক দিন গুজরানের ফাঁকে ফাঁকে ভালবাসার দাম দিতে গিয়ে নিজেকেই পাছে হারিয়ে ফেলি, এই ভয়ে আমি নিজেই মাঝে মাঝে কেটে দিই সেই আবেগ নির্ভর স্মৃতির সুতোগুলো। মুক্তি পেয়ে আমি একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচি ।একটু অন্যরকম আমি হয়ে আমি আসলে বাঁচিয়ে রাখি আমাকেই। প্রতিবার তাই নিজেকে আবার নতুন করে খুঁজে পাই ,নতুন করে নিজেকে ভালোবাসতে পারি, নতুন করে লিখতে পারি কবিতা ।বর্ষার জলের মত জীবনে আসুক প্রেম, বদ্ধ জলাশয়ের মত নয় ।জীবনে ভালবাসার গুরুত্ব প্রচন্ড বেশি উপলব্ধি করি বলেই বোধহয় আমি এই কথা বলতে পারি।
খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে ।মায়ের সঙ্গে স্কুল থেকে ফেরার কথা ,সেই সরকারপাড়ার ঢালু রাস্তা, সেইসব পুকুর ,পুকুরে বাবার সঙ্গে সাঁতার শেখাও মনে পড়ে। ছোটবেলার কথা মনে পড়লেই মনটা খুব চঞ্চল হয়ে ওঠে। অনেক কিছু ফেলে আসা দুঃখ এসে বড়ই আঘাত করে। বারবার মনে হয়, সেসব কেন আর কখনো ফিরে পাবোনা ?কেন তারা হারিয়ে যাবে চিরকালের মতো? শুধু স্মৃতির পাতায় তারা মাঝেমধ্যে চকচক করে ওঠে , মনে পড়ে ,আর তখনই মনটা খারাপ হয়ে যায়। হারিয়ে আমি আজও ফেলছি অনেক কিছুই ,সেই দামাল প্রেমকে হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে কিন্তু দ্রুতগতিতে, কলকাতা থেকে দূরে থাকতে থাকতে। প্রতিদিনের চেনা শহরটার সঙ্গেই আর তাল রাখতে পারছি না ।ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছি আমি প্রিয় শহর, প্রিয় বন্ধুরা আর প্রিয়তমা থেকে। সরে যেতেই হবে ,দূরে থাকতে থাকতে পারিপার্শ্বিকের স্মৃতিতে এভাবেই ক্রমশ ফিকে হয়ে যাব আমি, আমার স্মৃতিতে পৃথিবী ।শুধু কোন এক বর্ষার দিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে ,বৃষ্টিতে কাক ভেজা কোন একটা লোককে চলে যেতে দেখে, হয়তো ভীষণ কান্না পাবে ,এই কলকাতা থেকে এত দূরে থাকলেও। এ কথা ভাবলেই বড় দুঃখ হয়, হারিয়ে ফেলার ভয় হয়, এবং হারিয়ে আমি সত্যিই ফেলছি। প্রেম, ভালোবাসা, এইসব স্মৃতি,সব স্থির ধ্রুবতারার মতো, সেইটাকে যত্ন করে ধরে রাখতে চাই ।তাই আমার ভালোবাসা ঠিক এখানেই শেষ হয়ে গেছে ,সারা জীবনের মতো স্থির হয়ে আছে সেই অনুভব ।
আমি যে কে পৃথিবীর, তা সময়ের চিঠিতে লেখা থেকে যাবে,এইটুকুই স্বস্তি।আমার তাই কোন দুঃখ নেই,কারণ
পাওয়া এবং হারানো এ দুই'ই আমার কাছে ভালবাসার রূপ। ভালবাসা হল মোমবাতির আলোয় দেখা চেনা মুখ , ভালোবাসা হল বুক দিয়ে ধরে নেওয়া বৃষ্টির ফোঁটা, ভালোবাসা হল ইউক্যালিপটাস গাছ, ভালোবাসা হলো আঠাশে এপ্রিল ,বিদায় দেবার চোখের জল আর হেরে বাড়ি ফিরে শাওয়ারের জলে স্নানের সময় মিশে যাওয়া সারা জীবনের কান্না।ভালবাসা কখনো কফি হাউজের কোণের টেবিল,বাটার সামনে প্রতীক্ষা, এমনকি ভালোবাসা আমার কাছে স্বপ্নে দেখা মানবীর সঙ্গে দেখা না হওয়া পুরো সতেরোটা বছর। তবু আজও যখন মনে পড়ে তার কথা, তখন মন কেমন করে ,মন ছুটে চলে যায় ,কিন্তু কখনই বাস্তবিক শারীরিকভাবে তার কাছে যাওয়া যায়না, সে থেকে যায় চিরকালের জন্য অধরা।আমিও অবশ্য হতে পারিনি তার মনের কল্পিত প্রেমিক পুরুষ। আমি জানি আমার মধ্যে এমন কিছু নেই, যা তার চিরনতুন মনের অসম্ভব আবেগ আর জটিল ভালোবাসার বিমূর্ত্ত প্রতীক হতে পারে।
আমি বড় বেশী আবেগপ্রবন, কিন্তু আমি আবেগে ভেসে যেতে দিইনা নিজেকে,সংযত করে রাখি ।প্রয়োজনে কঠোর হই। নিজের আবেগ আর হৃদয়ের উন্মাদনা গুলোকে মেরে ফেলে মাঝে মাঝে আমি নিজেকেই বাঁচিয়ে দিই, নইলে আমি শান্তি পেতাম না ।আমি জানি এবং দেখেছি দূরত্ব বাড়ে এবং ঠিক তাই ।হারিয়ে ফেলা সত্যিই ভীষণ দুঃখের, ভীষন কষ্টের ।কিন্তু এই কষ্ট পেতে চাই না বলেও তা পেতেই হয়, পেতে হয়েছে এবং পেতে হবেও। যেমন এখন পেতে হলো ।এইসব ফ্যাকাশে দুরছাই দিনগুলোও দেখতে হল। কিন্তু তা সত্বেও এই দেখো আমি তো ঠিক বেঁচে আছি ।কবিতা লেখা হয়তো বন্ধ হয়েছে ,কিন্তু জীবন এগিয়ে চলেছে।শুধু একটা অভিমান,এতদিন পরেও সেই ছদ্মবেশিনী একইরকম অচেনা,অজানা।এ শুধু চলে যাবার সময় আমার দুঃখময় উপলব্ধি নয়,এ আমার হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস।অনেক কিছু জানা হলনা,আর হয়ত কোনদিনও হবেনা।একদিন আসবে,যখন আর কোনদিনও দেখা হবে না,কালের গহ্বরে হারিয়ে অনেক দূর চলে যাব আমরা, সেইসঙ্গে এইসব প্রশ্নও মিলিয়ে যাবে চিরকালের মত।যা করতে পারলাম না,যা বলতে পারলাম না,যে চিঠি কোনদিনও তার হাতে পৌঁছল না,তা শেষপর্যন্ত হয়ত ভালোর জন্যই হয়েছে।আমার দুঃখ এই দূরত্বের জন্য,এই জীবনযাপন,এই সমাজব্যবস্থার জন্য,যা বদলাবার আগেই সম্পর্কগুলো হারিয়ে ফেলব আমি,জীবনটা এতই ছোট আর দ্রুত। এই চলে যাবার যদি ক্ষমা থাকে কোন,মনে মনে ক্ষমাপ্রার্থী আমি।আমি জানি,আমি নই, আমি হতে পারিনি ,সেই আদর্শ প্রেমিক পুরুষ হতে। থাকি না আমি সেই অন্যরকম অসম্পূর্ণ পুরুষ হয়ে ,আমার কবিতার মধ্য দিয়ে ?এই সামান্য অথচ সারাজীবনের মনের কথাটা সবচেয়ে আগে একমাত্র সেই স্বপনচারিণীই বুঝতে পারবে, যখন আমি থাকবো না তার চোখের মাঝে। সেদিন সেই প্রেমকাহিনী আমায় জানাবে তো বর্ষা?
সব কথা বলা শেষ হল।বৃষ্টিশেষের ঠান্ডা হাওয়ায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনটা বোধহয় শান্তি পেল একটু।তারই মধ্যে দেখতে পেলাম ইউক্যালিপটাসের পাতাগুলো সবুজ থেকে আরো সবুজ হয়েছে।